(২০/১০/১৯৩৮ —
১৫/০৯/১৯৯৮)
[অমরশঙ্কর দত্ত থাকতেন পুরুলিয়া জেলার মানবাজারে। সম্পাদনা
করেছেন ‘জঙ্গলমহল’ পত্রিকা। প্রকাশিত বই ‘দিনকাল’ (‘তিন ভুবন’ কবিতা সংকলেনের
অংশ), ‘ভোটরঙ্গ’ (ছড়া), ‘নির্বাচিত
কবিতা’, ‘অন্তরঙ্গ কুঠার’ (গল্প)।
কবিপুত্র সন্দীপ দত্তের সহযোগিতায় কবির কিছু কবিতা এখানে প্রকাশিত হল]
একবিংশ শতাব্দী
একবিংশ শতাব্দীতে আমরা
আর মানুষ
থাকছি না
আমরা হয়ে
উঠব আরো
সন্দেহপ্রবন
এবং এ ওকে
শুঁকতে
শুঁকতে গোয়েন্দার
মতো বেঁচে
থাকব।
ব্যবস্থাপত্র
ব্যবস্থার ডিম ফুটে যেই বেরুল
অব্যবস্থা
সমর্থন
ঝনঝন করে বেজে উঠল—
“বহুৎ আচ্ছা
বহুৎ আচ্ছা!”
ভোরে পরিশ্রম
ভোরে পরিশ্রম খুব স্বাস্হ্যপ্রদ, অনুভূতিখানা
যেমন সম্ভ্রান্ত ঋজু তেজোময় এই সুবাতাসে
সার্টের কলার ওড়ে, চুল ওড়ে ফুসফুস বিহ্বল
সেইমতো নিয়ম ভাঙা তারপর প্রাকৃতিক নিয়ম
আশরীর পরিব্যাপ্ত— দুটো নিমপাতা
একঘটি জল
ঈষৎ উদ্যান চর্চা হালকা শ্রম এবং সজোরে লাথি
অর্থময় ব্যর্থ পণ্ডশ্রমে—
শ্বেতপদ্ম পুকুরে সামিল
কেবলই নিয়ম ভাঙি কাক ভোরে, বয়সে কাতর
নহি ভারাক্রান্ত নহি— “ভাইরাস ভাইরাস”
আর্তরব শহর কাঁপায় দেখি, কলকাতা কাঁপায়।
প্রাপ্তি
রৌদ্র দিলে, দিলে না শিকড়
রুখুশুখু মাটি
ফিরে যায় আমার দোপাটি
অথচ অদূরে ছিল
পলিময় মৃত্তিকা উর্বর
হতাশার সঙ্গে বাক্যালাপ
এক কথা দু-কথার পর বলি
“বিদেয়
হ”।
যায় না।
বলি— “তোর জন্য আমার
মানুষের সঙ্গে বন্ধন
ছিঁড়ে যাচ্ছে”
বলি— “তোর জন্য ওই দ্যাখ
বাড়ানো হাত
ফিরিয়ে নিচ্ছে ওরা”
ঘূর্ণির ভিতরে
খড়কুটোর মতো
একা-একা
লাট খাচ্ছি
এবার তুই যা।
না, যায় না।
গোখরা তবু একবার শেষ করে
আর এই হতাশা—
একটা মানুষকে
দিনের পর দিন
দিব্যি
কুরে কুরে খায়।
নামকরণ
উকিল হেমব্রম নাম রেখেছিল পিতা
সে কি মামলায় সর্বস্বান্ত হয়েছিল বলে?
অনুরূপ— দারোগা সরেন নাম পেয়ে যাই
ম্যাজিস্ট্রেট কিসকু, চৌকিদার ওরাং আরও
ইদানিং পেয়ে যাচ্ছি সভাপতি হেমব্রম।
মা-বাবার বাসনা সুন্দর এইসব নাম
পথে দেখা হলে বলি, ভালো?— চললাম
পিছনে তাকিয়ে থাকে, হরপ্পা মহেঞ্জোদারো!
কাটে বারোমাস
আদিগন্ত ছেয়ে থাকা সবুজ আড়ালে
কী নিপুন কর্মব্যস্ত নগ্ন দুটি
হাত
আলপথে ঝিরি ঝিরি জলের প্রবাহ
একাকী বাবলা জাগে সবুজ প্লাবনে।
আর দূরে কথা যেন কাঁদিছে ডাহুক
নিঃসঙ্গ যুবক এক উচ্চস্বরে
হাঁকে
এ মাঠের শেষে নদী, নদীর ওপারে
পড়ে আছে কার নীল শাড়ীর আঁচল।
এখানে মাঠের বন্যা থেকে বেছে
ঘাস
একটি অভ্যস্ত হাত চলে অবিরাম
পিছল শরীর হতে বস্ত্র খসে গেলে
ধানচারা রচে নেয় স্নিগ্ধ
অন্তরাল।
শরতের আয়ু শেষে স্বপ্ন ভেঙে যায়
দেখে চেয়ে মাঠে আর জেগে নেই ঘাস
না-মেটা বাসনাগুলি হৃদয় পোড়ালে
কচিঘাস ভেবে তাও কাটে বারোমাস।
ঘরে ফেরা
আমার চারপাশে ঘোরাফেরা করছে
আমার চেয়ে বুদ্ধিমান
আমার চারপাশে ঘোরাফেরা করছে
আমার চেয়ে চতুর
আমার চারপাশে
তাহলে, ঘরে ফেরাই ভালো।
আমার চারপাশে ঘোরাফেরা করছে
আমার চেয়ে ধুরন্ধর
আমার চারপাশে ঘোরাফেরা করছে
আমার চেয়ে লম্পট
পাশের লোকটি আমার চেয়ে
তের ইঞ্চি দীর্ঘ
তাহলে ঘুরে দাঁড়ানোই ভালো।
মেয়েটিকে মনে হয়েছিল চড়ুই
আসলে সে ছিল বাজপাখি
ছেলেটিকে মনে হলো বিনয়ী, নম্র
তার হাতের তালুতে ছিল
বাঘনখ
তাহলে, দেওয়ালে আয়না, একবার
নিজের দিকে ঘুরে দাঁড়ানোই ভালো।
১৯৬৬-৬৭
চারিদিকে আজ দুরন্ত ক্ষোভ
সন্ত্রাস, কানাঘুষো
অন্ধকারের আস্তিনে ঢাকা শহর
এখানে ওখানে গোপন জটলা
আলোচনা, ফিসফাস
চারিদিকে আজ দুরন্ত মেঘ
ব্যাপক সর্বনাশ।
হাত পা গুটিয়ে রয়েছে এখন
কম্বলে মুখ ঢেকে
তবুও ক্ষুব্ধ জনতার স্বর
ভেসে আসে থেকে থেকে
ভিত নড়ে যায়, গৃহকোণ কাঁপে
কাঁপে সারা অন্তর
আমারি ভিতর কথা বলে যেন
আগত রূপান্তর!
স্মরণ:
ভুদেব সেন
রক্তের নীল অন্ধকারে জীবনের
দস্যুতা
জানি সমস্ত লুন্ঠন করবে।
আমাদের প্রেম স্মৃতি কল্পনা
বাস্তব
লুণ্ঠন করবে সাম্প্রদায়িক
দাঙ্গায়
অনিয়ন্ত্রিত ষ্টেশানের মতো—
মাইকে দ্রুত ঘোষনা গাড়ি বদলের— নিখোঁজ শিশুর,
কার পরিত্যক্ত হোল্ড-অল পড়ে রইল
প্ল্যাটফর্মে
কিশোরীর মাউথঅর্গান, যুগসন্ধির
সম্ভাবনাময়
পড়ে রইল কার রক্তাপ্লুত মৃতদেহ
সায়া সেমিজ পিয়ানো
আমরা তবু পাশাপাশি, হাতে হাত
রেখে মুখের ভিতর
আয়োডিনের গন্ধ নিতে নিতে তোমাকে
স্মরণ করব বন্ধু।
হাওয়া শহর
এক জন্মের অপরাধ শুধরে নেব
তখন কোন আগামী নেই
তবু তোমরা আগামীর কথা বলো
সম্ভাবনার কথা বলো
চলতে চলতে থেমে গিয়েছে কার পা
শহর জুড়ে স্তব্ধ বাড়ি, পোড়োবাড়ি
প্রতিধ্বনিময়, ভাঙা দেওয়াল
প্রতিধ্বনির ভিতর ঋত্বিক ঘটকের
ছবি
ছবি ধ্বংসের পতনের অধঃপাতের
শুধু নিজের শবজুড়ে পড়ে থাকে
মহাকাল
আর তোমরা
বারেবারে আগামীর কথা বলো
সম্ভাবনার কথা বলো।
আজ থেকে
আজ থেকে বিভেদসৃষ্টিকারী সমস্ত
বস্তুর প্রতি আমি বিরূপ হব
কথা দিচ্ছি আমি বিরূপ হব
দুর্দান্ত প্রতাপশালী বলে
নিজেকে ঘোষণা করব না।
ঘোষনায় কোন স্নিগ্ধ ফল এযাবৎ
মানুষ পায়নি। তুমি শিখিয়ে
দিয়েছ।
তোমার সম্মুখে আমি কোনদিন চিৎকার
করে
কোন অত্যুজ্জ্বল সিদ্ধান্তের বিষয়ে
বলব না। এতদিন বলতাম।
আমি আর অত্যুজ্জ্বল বিষয়ে কোন
প্রস্তাব রাখব না।
কথা দিচ্ছি সেইসব খুনসুটি
মেয়েদের প্রতি— যারা
এর-কথা-ওকে ওর-কথা-তাকে লাগিয়ে
কেবলই
জটিল নাটক সৃষ্টি করে যেতে চায়— সেইসব মেয়েদের প্রতি
আর কোন আস্থা নেই। ভীষণ জ্বালায়
বুক ঝাঁঝরা করে যারা
স্বভাবে উদাস— যেন কিছুই
ঘটেনি— পাপ হত্যা
ধর্ষণ লুন্ঠন
কিছুই ঘটেনি বলে যারা ভাবে— সেইসব মেয়েদের প্রতি
আর কোন আস্থা নেই। মেয়ে মাত্রেই
আর কোন আস্থা নেই।
শুধু তুমি ছাড়া। কথা দিচ্ছি, আজ
থেকে আমি ক্রমাগত
বিভেদসৃষ্টিকারী বস্তু থেকে সরে
যাব। আজ থেকে
আমি ক্রমাগত তোমার ছায়ায়
আস্থাশীল হতে চেষ্টা করব।
যোগ ও জীবন
বড় ঘোর আকাশ রুদ্ধ ভাসে শুদ্ধ
মেঘমালা
অসংবৃত দেহে হাঁটে মত্ত
আপিলা-চাপিলা।
অবরুদ্ধ ক্রোধে প্রভু
ব্রহ্মতালু ফাটে
বোধ গতিরোধ করে মিছিল চৌকাঠে।
বিষে বিষক্ষয় তবে এসো বিষহরি
আরোগ্য নিষিদ্ধ যদি মৃত্যু ধন্বন্তরি।
পার্থিব বিষয় যতো অপার্থিব করে
বাউলের একতারা ধন্য নখের ঠোকরে।
পাথর পাথর যদি শিলা স্তব্ধমাত্র
শিলাময়
না জানি কেমনে তবে কোলায়েজ জন্ম
লয়।
যুবক যুবতী যত তিরবিদ্ধ মানসিক
কুণ্ডয়নে
মানস মুক্তির পুষ্প ফোটে তবু
কাব্য কুঞ্জবনে।
নদীর নাব্যতা শেষ দেশজুড়ে শুধু
ভূমিহার
ভাবিয়া না পায় লোক কে কার আহার।
যোজন যোজন পথ হেসে খেলে আসে ঢলে
পড়ে
আপিলা-চাপিলা ত্রাহে জল পড়ে
পাতা নড়ে।
বারান্দায় ত্রিকোন চাঁদ
চাকচিক্যময়
কোন শিল্পী করে তোলে তাকেও
বাঙময়।
এই যে শরীর আর শারীর ধর্ম
ওতোপ্রোত
ত্বক বিমোহিত করে আজ মন
অস্তমিত।
গুহা
গুহা আমাকে ভিতর থেকে
ক্রমাগত
শেষ করে।
তবু একদিন এখানে
আলোচনা হবে
একটা মানুষ
শেষ হতে হতে
বেশ কিছুদিন পতাকার মতো
উড়ছিল।
বেশ ভালো কবিতাগুলো
ReplyDeleteখুব সুন্দর
ReplyDeleteসুন্দর সব কবিতা
ReplyDeleteভালো লেখা
ReplyDeleteআরও পড়তে চাই
ReplyDelete