চারপাশের কথা বললে, তেমন আহামরি বর্ণনা
হবে না। ঘরটা ভালোই বড়, মাথার উপরে ফ্যান ঘুরছে যদিও স্পিড খারাপ। রুমে দুইজন কম্পিউটার নিয়ে কাজ করে
যাচ্ছেন আর তাদের নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন চন্দন বেরা। পাশেই এক কোণে বইয়ের স্তূপের
মধ্যে বসা মাহমুদ। তার শরীর অনেক ঘামছে। অবশ্য ঘামার কারণ দুশ্চিন্তা নয়, যে কারণে ওর ঘাম
হচ্ছে সেটা ভাবলেই ওর লজ্জা লাগে।
হোস্টেল থেকে বের হবার পর হোস্টেলের মালিকের স্ত্রীকে
সে দেখে ফেলেছে। ভদ্রমহিলাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছিল উনি মাত্র গোসল করে এসেছেন। চুল
ভেজা, মুখে তখনও পানির
ছিটা। আর শরীরের পানি ঠিকমতো না মুছায় বুকের দিকে কাপড় লেপটে ছিল। অন্য কোথাও চোখ না
যেয়ে মাহমুদের সোজা চোখ চলে গিয়েছিলো ওই বুকের দিকে। এইসব ক্ষেত্রে বলে চোখ
আয়তাকার হয়ে যায়। মাহমুদ প্রায় নিশ্চিত ওর চোখ আয়তাকার হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এটা প্রথম
না। ভদ্রমহিলার কাণ্ডজ্ঞান নেই। প্রায়ই হঠাৎ রাস্তায় নেমে পড়েন বুকে ওড়না ছাড়া।
ঠোকাইদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দেন। ঠোকাইরা তাঁকে ঘিরে ধরে। পথচারীরা তাঁর দিকে ঘৃণার
চোখে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু ওঁর মনে হয় এসবে কিছু যায় আসে না।
ওঁর আর-একটা শখ হল বিভিন্ন রকমের কেক বানানো। সে কেকের মধ্যে চকোলেট
আর কেরামেলের পরিমাণ হল ব্যাকহোলের দৈর্ঘ্যের সমান। তবুও হাসিমুখে খেতে হয়। ওঁর
চোখের পরিমিত আগ্রহ এড়ানো যায় না।
মাহমুদের সেই বুকের দৃশ্য বারবার মনে পড়তেই বুক কেঁপে
উঠছে। আজ আবার সে
আন্ডারওয়্যার পড়েনি। বারবার প্যান্টে হাত দিতে হচ্ছে। বুকের দিকে যে এই চোখ
যাওয়াটা ধর্ম অনুযায়ী পাপ হলেও কবির ভাষার অনুযায়ী এটা বাস্তব কথা। কবি সুবোধ
সরকার লিখেছেন তাঁর ‘লোকে কেন বিয়ে করে’ কবিতায়—
যেদিন থেকে সে বুঝতে পারে স্তন অতি দুর্বল জিনিস
মা-ও তাকে আর স্তন
দেবে না
সেদিন থেকেই তার অভ্যাস খারাপ হতে থাকে।
এই অংশের যুক্তি হল একটি বাচ্চা তার প্রথম খাদ্যগ্রহণ
করে মায়ের স্তনের বোঁটা হতে। তাই স্তনের প্রতি এত মায়া। তাহলে মেয়েরাও কী এমন করে?
কবির দার্শনিক জ্ঞান অনুযায়ী, মেয়েরাও অন্য মেয়ের
স্তন দেখে। কিন্তু তারা বেশি দেখে অন্য মেয়ের পেট। পেটের মেদের অনুপাত তারা হিসেব করে
নিজের শরীরের কুমারীত্ব তুলনা করে।
মাহমুদ সরল গলায় বলল, অভিজিৎদা, একটু বাথরুমে যাব।
অভিজিৎ বেরা উত্তর দিলেন না। উনি আপন মনে অন্য লোকের
সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। ওঁর ইচ্ছা হয়েছে বাতিঘর সংস্থার মতো বগুড়াতেও এমন একটা
সংস্থা গড়বেন। এর জন্য এত আয়োজন। বাতিঘরের মটোও উনি নিজের লোগোতে ব্যবহার করেছেন।
দুপুরের দিকে উনি মাহমুদের দিকে তাকালেন। ওঁর চোখ চলে
গেল মাহমুদের প্যান্টের দিকে। মাহমুদের অবাক লাগল। চেহারার দিকে না তাকিয়ে প্যান্টের দিকে চোখ কেন?
অভিজিৎ বেরা এবার চেয়ার নিয়ে এসে ওর মুখোমুখি বসলেন। প্রথম কথাই বললেন, ভাত
খেয়েছেন?
মাহমুদ ভাত খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। ওর শরীরের স্থূলতা
অনেক বেড়ে গেছে। অতিরিক্ত ওজনের জন্য প্রায়ই ওর চর্মরোগ হয়। ওষুধ খেলেও যায় না। তাই
ও এখন আর ওষুধও খায় না।
মাহমুদ বিনয়ীভাব নিয়ে বলল, জ্বি।
অভিজিৎ বেরা বললেন, আমার মা ছোটবেলায় টমেটো দিয়ে রুই
রান্না করতেন। ঝোল পুরা লাল হয়ে যেত। খেতে মিষ্টি লাগত।
মাহমুদ মনে মনে বিরক্ত হচ্ছে। রুইমাছের রান্নার সঙ্গে
ওর বইয়ের সম্পর্ক কী? এই লোক তার টেস্ট পরীক্ষার সময়ে জোর করে তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বইয়ের প্রুফ
দেখিয়েছে। মাহমুদ হাসল।
অভিজিৎ বেরা এবার সোজা হয়ে বসে বললেন, আপনার বই আমি
করব। কিন্তু কবে আসবে তা বলতে পারছি না। আপনার পাঠক খুব কম। ফেসবুকে এ নিয়ে পোস্ট
করেও কোনো সাড়া পাইনি।
—দাদা,ভরসা রাখুন। বই বিক্রি হবে। গল্পটা ভিন্ন রকম।
অভিজিৎ বেরা অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন, গল্প ভিন্ন হলেই পঞ্চাশ
হাজার টাকা উঠে না।
মাহমুদ যখন বের হল, ততক্ষণে সরকারি
দলের সম্মেলন শুরু হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী এই রাস্তা দিয়ে সম্মেলনে যাবেন। তাই
রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মাহমুদ সিগারেটের টং খুঁজতে লাগল। প্রচণ্ড ক্ষিধে
পেয়েছে। তবে খাবার কেনার মতো টাকা নেই। আর-একটু হাঁটতেই সামনে টং পড়ল। টংয়ের দিকে আগাতেই
দেখলো ওসি নজরুল মিয়া দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছেন। মাহমুদের বুক ধকধক করে উঠল। বারবার কেন এই
লোকটার সঙ্গে দেখা হয়? এ কি তার পিছু ছাড়বে না?
মাহমুদ আড়ালে গেল না। সেই টংয়েই চা আর সিগারেট চাইল।ওসি ওকে দেখেই
বললেন, ভালো আছো?
মাহমুদ উত্তর দিল না। জোরে সিগারেটে টান দিল। ওসি বললেন, তোমার
উপর করা জিডিটা নিয়ে অনেক বিপদে আছি।
মাহমুদ চমকে উঠল। কীসের জিডি? অলরেডি তাকে
পর্যাপ্ত অর্থ দেওয়া হয়েছে। মাহমুদ বলল, আপনি বলেছিলেন এটা আপনি দেখবেন।
—তো? দেখছি না কে বলল? আসলে ড্রাগের ব্যাপার যে। তার উপর তুমি এক পুলিশ সার্জনের গায়ে হাত দিয়েছ।
মাহমুদের কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। সে মোটেও কোনো
সার্জনকে মারেনি। শরীরে ড্রাগ ছিল। কিন্তু সে মোটেও মাতাল ছিল না। ড্রাঙ্ক টেস্টে সে
ভালোই করেছিল।
ওসি সাহেব টংয়ের মালিককে বললেন, ওই শোন। এই ছেলের কাছ
থেকে টাকা নিবি না।
মাহমুদ প্রতিবাদ করতে যেতেই বললেন, আহা! থাক। সামনে তো তোমার
বাবা আমাদের কিছু দিবেন। এটা সামান্য প্রতিদান মাত্র।
ওসি সাহেব হাঁটা দিতেই পুলিশের হুইসল বেজে উঠল। প্রধানমন্ত্রী
যাচ্ছেন। এক রিকশাওয়ালা চিৎকার দিয়ে বলে উঠল, খানকির দেশ।
অরণির কয়েকদিন ধরে ঘুম হচ্ছে না। ঘুমাতে গেলেই সে
স্বপ্নটা দেখে। সাধারণত বাস্তবে স্বপ্নের কোনো প্রয়োগ ঘটে না। কিন্তু এই স্বপ্ন সে
বারবার দেখে বাস্তবের জন্য। এখনও ওর মনে পড়ে, লোকটা ওর রুমে ঢুকে
দরজা বন্ধ করে দিল। হাতে পকেটনাইফ। পাশের ঘরেই ওর ছোটভাই তালহা আপনমনে
গান শুনছিল।
তালহা যখন অরণির রুমে গেল ততক্ষণে কাজ হয়ে গেছে। লোকটি
চলে গেছে। অরণির সারা শরীরে ছিল ছুরির পোঁচ। বিছানার চাদর আর ফ্লোর ছিল রক্তে ভরা।
অরণির মা ওকে একটুও বিশ্বাস করলেন না। বারবার একই কথা,
ছেলে ভালো। নামাজ পড়ে। মসজিদের প্রত্যেক ওয়াজে যায়। কুরআন খতম দিয়েছে ছ’ বার।
ওর বাবা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলেছিল, আমার মেয়ে মিথ্যা বলছে? ওর শরীরের এসব
তাহলে কী?
অরণির মা অনুপল সময় না নিয়েই বলেছিলেন, ও নিজে করেছে
এসব।
অরণিকে ডাক্তার দেখানো হয়নি। ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেই
বলতে হবে পুরো ঘটনা। মার কাছে যেন নিজ মেয়ের চেয়ে পরের ঘরের ছেলের প্রতি দরদ বেশি।
তাছাড়া পরিবারেরও বদনাম হবে। ক্ষতস্থান শুকালেও দাগ এখনও রয়ে গেছে। অরণি এসব লুকায়
না। ও ঠিকই হাফহাতা জামা পরে। এসব ঢেকে রেখে কী হবে? অরণি বুঝতে পেরেছে
ও এমন সমাজে বাস করে যেখানে মেয়েদের জন্মের পরেই নিজের যোনি সমাজের কাছে বন্ধক
রাখতে হয়।
লোকটা এখনও ওর কাছে আসে মাঝেমাঝে। সেদিন কলেজ থেকে
বের হতেই দেখল লোকটা দাঁড়িয়ে। অরণি নিজেই গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, আপনি এখানে কেন?
লোকটি হেসে বলল, পুরনো ছাত্রীকে দেখতে এসেছি।
—কীসের ছাত্রী? আমি আপনার ছাত্রী
নই।
লোকটা ওর হাতের দিকে তাকিয়ে বলল, ক্ষতস্থানগুলি দেখি
শুকিয়ে গেছে। খুব ভালো।
বলে হাসি। অরণির শরীরে যেন উনি কিউবিক আর্ট করেছেন। সেই
কীর্তি দেখে ওঁর গর্বে বুক ভরে যায়।
লোকটি ওকে ফেসবুকেও নক করে অরণি প্রায়ই ব্লক মারে। কিন্তু
লোকটি অন্য অ্যাকাউন্ট দিয়ে আবার মেসেজ দেয়। মাকে বললে উনি বলেন, বেয়াদবি করিস কেন? বলবি কথা।
অরণি এসব শুনে বারান্দায় কাঁদে। কেউ নেই। একজন ছিল। অরণির মনে হত ও
এসেছে ওকে উদ্ধার করতে। ওকে যোনি বন্ধক রাখার অভিশাপ থেকে মুক্ত করবে। কিন্তু
সেটাও হয়নি। এই দোষও হয়তো ওর।
অরণি ঠিক করল আজকে মাহমুদের সঙ্গে কথা বলবে। সে এখনও
ওকে বিষ দিয়ে যায়নি।
সূর্যের পাঞ্জাবিটা ঘামের কারণে একদম গন্ধ হয়ে গেছে। ওর
ইচ্ছা করছে এক্ষুনি সাবান দিয়ে গোসল করতে। কিন্তু ওকে এখনও ক্লাবরুমে বসে থাকতে
হচ্ছে। সিনিয়ররা ওকে ডেকে এনেছে। কিছুদিন আগে রেজিস্ট্রেশন বক্স থেকে তিন হাজার
টাকা চুরি হয়েছে। হিসাব মিলছে না। ক্লাবের এক জুনিয়র অভিযোগ করেছে সূর্য এটা
সরিয়েছে। সূর্যের এসব নিয়ে খটকা লাগে। টাকাটা ওরা সবাই মিলে সরিয়েছিল। জুনিয়ররাও ছিল। টাকাটা ওর একার
পেটে যায়নি। ওই টাকায় কেনা ভদকা আর গাঁজা সবাই মিলে খেয়েছে।
নাফিস ভাই ঢুকতেই সূর্য উঠে দাঁড়াল। নাফিস ভাই কোনো
সৌজন্যে গেলেন না। উনি কড়া গলায় বললেন, টাকাটা কোথায়?
সূর্য বলল, আমি টাকার ব্যাপারে কিছুই জানি না। আমি ছিলাম
না তখন।
—তোমার ব্যাপারে প্রমাণ আছে।
—ভাই, থাকুক। আমি মোটেও এসবে জড়িত ছিলাম না।
—আবার অস্বীকার করছো?
সূর্য মুখ নামিয়ে ফেলল।
নাফিস ভাই বললেন, তোমার প্যালেন পাওয়া নিয়ে সামনে
ঝামেলা হবে। আমি নিজে তোমার বিরুদ্ধে ভোট দিব।
সূর্য বলল, এই ক্লাবে আমার চেয়ে বেশি কেউই কাজ করেনি।
আপনি এটা করতে পারেন না।
নাফিস ভাই যেতে বললেন, আমরা চোরদের ক্লাবে রাখতে চাই
না।
সূর্য বের হয়েই রুণাকে ফোন দিল। রুণা আজকাল ওকে পাত্তা দিচ্ছে না। ফোন দিলেই বলে, আমি
একটু ব্যস্ত।
অথচ অরণি কখনও এমন করত না। যখনই ফোন দিত, ও সঙ্গে সঙ্গে ধরত। এত ভালোবাসাও
সূর্যের ভালোলাগত না। সূর্য আবেগ-অনুভূতিহীন হতে চায়। সেজন্যেই ও কখনও ওর বাবার
মৃত্যুর কথা বলে না। এমনকি রুণাও জানে না। জানত অরণি। মনে পড়ে, এই গল্প শুনে অরণি
অনেক কেঁদেছিল।
ব্রেকাপের সময় অরণি একটুও উচ্চবাচ্য করেনি। এটাও ওর
অস্বস্তি লাগে। যদি গালিগালাজ করত তবুও হত।
রুণা ফোন ধরেই বলল, আমি বাইরে।
সূর্য পাত্তা দিল না। বলল, দেখা করো।
—এখন?
—হ্যাঁ।
—সময় বেশি হবে না।
—আচ্ছা।
সূর্য বুঝে গেছে এই রিলেশনশিপও একটা শেষ অবস্থানে চলে
গেছে।
সূর্য দোকান থেকে সিগারেট কিনল। সিগারেট খাওয়া ওর নিষেধ। ফুসফুসের প্লুরা চিকন হয়ে
গেছে এই সিগারেটের জন্য। সিগারেট খেলেই নাক দিয়ে রক্ত পড়ে। তা-ও ও খায়। কেন খায়
জানে না।
মাহমুদের কথা ভাবলে ওর খারাপ লাগে। ওই রাতে ড্রাগ সে-ও
নিয়েছিল। কিন্তু নেপোটিজমের
কারণে সূর্য পার পেলেও মাহমুদ পার পেল না। এখনও ওকে এর জবাবদিহি করতে হয়।
থিয়েটার স্কুলে মাহমুদ ছয় মাসের কোর্স আর চার দিনের
মধ্যে কমপ্লিট করবে। আজ শেষ ক্লাস। আজকে জর্জ বার্নাড শ-এর পিগমালিয়ন নাটকের উপর
প্রবন্ধ লেখার অ্যাসাইনমেন্ট ছিল। মাহমুদ যা পেরেছে লিখেছে।
মোস্তফা সাহেব ক্লাস শুরুর আগেই মাহমুদকে ওঁর রুমে
ডাকলেন।
মাহমুদ ঢুকতেই মোস্তফা সাহেব বলে উঠলেন, তোমার অবস্থা
এত খারাপ কেন?
মাহমুদ জানত উনি এসবই বলতে ডেকে এনেছেন। এটা নতুন না।
এই নিয়ে হবে ছ’ বার। মাহমুদের লেখা নাটক ওঁর একটুও ভালোলাগে না। নাটকে বাস্তবতা
থাকলে ডায়লগের অভাব, ডায়লগ থাকলে নির্দেশনার অভাব— কোনো অভাব থাকবেই।
মাহমুদ বলল, কেন স্যার?
—তোমার মতো এত খারাপ ছাত্র দেখিনি। এই তোমার
পোস্টমর্ডানিজমের নাটক? এই নাটক মঞ্চে ফুটিয়ে তোলা যাবে? আর তোমার লেখায় দেখি যৌনতা বেশি। এতকিছু থাকতে তোমার যৌনতাকে কেন শিল্পে পরিণত
করতে হবে?
উনি থেমে পানি খেলেন। তারপর আবার বলতে লাগলেন, তোমার
আজকের লেখা প্রবন্ধও তো অনেক খারাপ। এই নাটক তুমি পড়ে থাকলে এসব লিখতে না। কিছুই
হয়নি। শোনো, তোমাকে বলি তুমি আর
এসবে জড়িয়ো না। বুঝলে?
সিগারেট
খাবার সময় অনেক বিচিত্র স্বভাবের লোক দেখা যায়। এদের কথাবার্তা শুনতেও ভালোলাগে। এর
মাঝেই হঠাৎ কোথার থেকে কিছু কুকুর এসে হাজির হয়। এসে লেজ দুলাতে থাকে। যেন তারাও
সিগারেট খেতে চায়।
আজকে দুইজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক আলাপ করছেন। আলাপের
বিষয় তাদের স্ত্রীদের নিয়ে। একজনের স্ত্রী ইদানীং আর মিলনে আগ্রহী না। খুব
ধর্মকর্মে জড়িয়ে গেছে। মিলনে মাঝেমাঝে রাজি হলেও ইসলাম মোতাবেক করতে হয়। এর বেশি
কিছু করা যায় না।
মাহমুদ সিগারেট ফেলে দিতেই দুইজন ঠোকাই এসে সেটা
কুড়িয়ে নিয়ে ছুটে পালিয়ে গেল।
রাস্তায় হাঁটার সময় আগে মাহমুদ মেয়ে দেখলে সরে যেয়ে
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে যেত। এটা বলে এক ধরনের ব্রাহ্ম আচরণ। ব্রাহ্ম ধর্ম থেকে এটা
এসেছে। কিন্তু একদিন এটা করে বিপদে পড়ল। এক মেয়েকে এভাবে সাইড দিতেই সে তীব্র কণ্ঠে বলেছিল, আপনি
আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে আছেন কেন? অসভ্য, কুলাঙ্গার কোথাকার!
সেদিন থেকে মাহমুদ আর এটা করে না। মেয়েরা পিছন দিয়ে
সাইড চাইলেও ও সাইড দেয় না।
হোস্টেলে ফিরতেই ওর রুমমেট সুশান্ত এসে বলল, পুলিশ
এসেছিল তোর খোঁজে। তোর নামে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট আছে।
মাহমুদ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। বাবা অবশেষে তাহলে আর টাকা দিবেন না। সেই ভালো।
মাহমুদ রুমে ঢুকতেই ওর মনে পড়ল আজ অরণিকে পটাশিয়াম
পারম্যাঙ্গানেন্ট দেওয়ার কথা।
মাহমুদ আবার নেমেই গেল হোস্টেল মালিকের কাছে। ভদ্রমহিলা
দরজা খুলতেই আবার মাহমুদের চোখ চলে গেল ওঁর বুকের দিকে।
মাহমুদ শান্ত গলায় বলল, আন্টি, ওয়াইট চকলেট হবে?
অরণি সিগারেটের ধোঁয়া খুব কায়দা করে ছাড়ে। দেখতে
ভালোলাগে। মাহমুদ ছোট একটা শিশি দিয়ে বলল, নাও, পর্যাপ্ত আছে।
অরণি নিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল।
—কখন খাবে?
অরণি চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, আজ রাতে।
মাহমুদ কাশতে কাশতে বলল, খালি পেটে খেয়ে নিও। এতে
কষ্ট কম হবে। বমি হবে না।
অরণি বলল, আমি ইদানীং একটা স্বপ্ন দেখছি। স্বপ্নে আমি
দেখি আমাকে রেপ করা হচ্ছে।
—স্বপ্নে আলমারি থাকে?
অরণির ভুরু কুঁচকে গেল। বলল, মানে কী?
—আহা বলো না। থাকে? কিংবা ব্যাগ টাইপের
কিছু?
অরণি ভেবে বলল, হ্যাঁ থাকে।
—তাহলে ভয়ের কিছু নেই। এটা সাধারণ স্বপ্ন। ফ্রয়েড তার
গবেষণায় তার প্রমাণ দেখিয়ে গেছে।
কিছুক্ষণ নীরবতা। শেষে মাহমুদ বলল, অরণি, জানি সূর্য তোমাকে
ভালোবাসে, হয়তো আমার চেয়ে
বেশি। কিন্তু আমি কি তোমাকে খুশি করতে পারতাম না? আমাকে একটা সুযোগ
দিতে।
অরণি অন্যমনস্কভাবে বলল, তোমার না একটা কবিতা আছে। সেখানে
নিমপাতা নিয়ে কী যেন লিখেছিলে। বলো তো।
মাহমুদ গুনগুন করে বলল—
নিমপাতার মিমে পণ্যস্ত্রীর অভিনব গোসল প্রক্রিয়া
ঈশ্বরের ইউটিউব ভিডিয়োতে স্বনক হতে চায়।
লাইন শেষ হতেই মাহমুদ দেখল অরণি মুখ ঢেকে ফেলেছে। শরীর
কাঁপছে।
মাহমুদ বিল মিটিয়ে উঠে গেল।
ক্লাবের আজকে অনুষ্ঠান। আজ প্যানেল দেওয়া হবে। সূর্যের
আগ্রহ নেই। সে ভবনের উলটোদিকে কাঠগোলাপ গাছটা দেখছে। এই গাছটা মাহমুদের খুব প্রিয়
ছিল।
মডারেটর এসে নাম ঘোষণা করতে লাগলেন, ফাইয়াজ আহমেদ
সূর্য জেনারেল সেক্রেটারি।
—প্রবীর ধর, সাধারণ সম্পাদক।
—ইমতিয়াজ কাব্য, প্রেসিডেন্ট অফ পাবলিকেশনস...
অনুষ্ঠান শেষ হতেই সূর্য দৌড়ে গিয়ে নাফিস ভাইকে বলল, এসব
কী? আপনি বলেছিলেন
আমাকে পদ দিবেন না। এখন আবার আমি ক্লাবের লিডার কেমনে হই?
নাফিস ভাই হেসে বললেন, তোমার মতো দৃঢ় ছেলেই তো ক্লাব
চালাবে।
বলে কোকের বোতল নিয়ে চলে গেলেন।
সূর্য
দ্রুত বের হয়ে ক্যান্টনমেন্টের বাস ধরল।
মাহমুদের কথামতো অরণি ডিনার করেনি। ওর হাতে শিশি। অরণির
চোখভরতি পানি। সে এই যোনি বন্ধক রাখা সমাজকে বিদায় দিবে। এর মধ্যে আবার প্রশান্তিও
আছে।
অরণি শিশিটা খুলে পুরোটা মুখে ঢেলে দিল। দিতেই অরণি বিস্ময়ে
হতবাক হয়ে গেল। এ যে চকোলেট! মাহমুদ এরকম প্র্যাঙ্ক করল?
রুম থেকে বের হয়ে অরণি মাহমুদকে ফোন দিতে যাবে তখনই
দেখে ফোনে ষাটটা মিসকল। সব সূর্য দিয়েছে। অরণি ফোন দিতেই সূর্য বলল, নীচে আসো।
—কেন?
—নীচে আসো বলছি।
—রাত অনেক হয়েছে তো। এখন আসলে…
—তুমি না আসলে আমি সারারাত তোমার বাসার নীচে দাঁড়িয়ে
থাকব।
সূর্যের জেদ অনেক। ও যেটা বলে সেটাই করবে। অরণি
সুন্দর করে চুল আঁচড়াল। চোখের পানি মুছল।
দারোয়ান
ঘুমিয়ে গেছে। অরণি আস্তে করে গেট খুলে বের হতেই দেখলো সূর্য দাঁড়ানো। বুঝাই যায় ও কান্নাকাটি
করেছে। এমন আবেগহীন
ছেলেরাও কাঁদে?
অরণিকে
দেখে সূর্য দৌড়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে ফোঁপাতে লাগল। বাচ্চাদের মতো বলতে লাগল, আর তোমাকে ছেড়ে যাব না। আর
যাব না। আর যাব না…
সূর্যের
চোখের পানি অরণির ঠোঁটে এসে পড়ল। অরণি তখন ভাবছে মাহমুদের কথা। কীরকম ধোঁকাই না ছেলেটা
দিল।
অভিজিৎ বেরা বললেন, ভাই আপনার বইটা করতে পারব না। বুঝেনই
তো, সাড়া নেই তেমন। এই
অবস্থায় বই করলে অনেক ক্ষতি হবে।
মাহমুদ উঠে দাঁড়াল। অভিজিৎ বেরা বলে উঠলেন, একটু চা?
মাহমুদ সূর্য আর অরণির ঘটনা জানে। অরণি ফোন দিয়ে অনেক
কেঁদেছে। অরণি বারবার বলেছিল, কেন তুমি এমন করলে? কেন আমাকে মুক্তি
দিলে না।
মাহমুদ হেসে বলেছিল, তোমাকে
বলেছিলাম আমার আগে তোমাকে মরতে দিব না। আমি কথা রাখব।
সিগারেট
ধরিয়ে মাহমুদ রিকশা ডাকল। রিকশাওয়ালা জিজ্ঞাসা করল, কই যাইবেন?
মাহমুদ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, পল্টন থানা।
No comments:
Post a Comment