বাক্‌ ১৪২ ।। সোনালী চক্রবর্তী


সিরিজ: প্যান্ডেমিক


কোয়ারেনটাইন 

গলানো গালা হাতের চেটোয় না পড়লে কী করে টের পেতে নেশার অন্ধ গড়ন ? অহঙের ফিসফিস দিব্বি বুঝিয়ে রেখেছিলো তোমায় আগুনের চামড়ায় কোনোদিন বলিরেখা পড়ে না  পূর্ণতার শ্মশানে তুমি তো রাই মধু জ্ঞানে চাটছিলে বসে বসে ঠোঁটে শুকিয়ে ওঠা বেহুদা নোনতা, ভালোই জানতে তোমার মিথিক্যাল গলি খুঁজিতে তমালের ঠিকানা পড়ে না। ঝুটো আলোর মেলায় দাঁড়ানো সেই তুমি হটাত দেখলে স্বপ্নের ড্রাগনের মত অজস্র মুখোশ দৌড়ে বেড়াচ্ছে বিশুদ্ধ নিরোধের খোঁজে। ভোরের ফাঁকা বাসগুলো নির্ভুল পৌঁছে দিচ্ছে লাতিন দুপুরগুলোতে যেখানে আদিম পরিণতির আধুনিক আলপনা এঁকে রাখা দেশ জোড়া গ্রামের সব কটি উঠোনে। তুমি সেই গুপ্তধন খোঁজা শুরু করলে যেটার সূত্র আঁকা থাকে ব্যক্তিগত অন্ধকারে। অনেকগুলো মাংস খোয়ানো হাঙরের কঙ্কাল উপহার হিসাবে পেয়েছো জানি, কোনোদিন বলোনি মৎস্যকন্যার হিজাবের নীচে প্রেতমুখের অতিরিক্ত কিছু সাজানো ছিল না। এখন কি আর সময় আছে জানানোর, জোয়ারে ভেসে যায়, সে চাঁদ কখনো ঋতুমুখে আঁকোনি। একটা গাছ, শান্ত পাথর যা বিশ্বাস করাতে পারেনি, কী অবলীলায় কিছু নগ্ন ভাইরাস তোমায় দেখিয়ে দিয়ে গেলো, একা হতে চেয়ে যখন তুমুল দৌড়াচ্ছে সভ্যতা, ক্রমাগত মরতে চেয়ে প্রবল বেঁচেই ছিলে তুমি...




 পোস্ট করতালি

দেখো, সব ঋতু ধুয়ে যাচ্ছে ক্রমে অনিবার্য প্লাবনে। কখনো রঙ মেপে সে আতঙ্ককে যমুনা জ্ঞানে ডুব দিচ্ছ তুমি আবার ময়ূরের আলোয় মেখে নিতে চাইছ যেন আজই শেষ গোধূলি। তাকিয়ে দেখো সমস্ত জনপদ ফিরে পাচ্ছে তাদের ঋষ্যমূক অবস্থান। যে উন্মাদ শতচ্ছিন্ন হয়েও সুর মেলালো আজ সরল বালকের শুভেচ্ছায়, তার ভবিতব্যে অলীক ছাড়া কোন উপশম রাষ্ট্র বরাদ্দ করেনি। তুমি তো কৃষ্ণা দেশভাগ দেখোনি অথচ শরীরে কাঁটাতারের উল্কিকে প্রতিফলিত হতে দেখেছ আইনের পাথুরে চোখে। সেই তুমিই আজ আদিগন্ত শূন্য এক সময়ের চর পেরোতে পেরোতে নিজেকে বালির জাহাজ বলে ভুল করে কেন ফেলছো? যেন জাদু অহিফেনের গণ্ডী ভেদে তোমার বৈকল্যে আঁচড় কেটে যাচ্ছে সমস্ত অনদেখা প্রিয়মুখ। স্মৃতি হাতড়াও, সোনালি গ্রীবার তুমিই তো সখী ছিলে মোয়ার, যখন ডোডোর উড়ান দেখত লুসি...
জানি, মৃত দেশ থেকে ভেসে আসা বিপন্ন হাহাকারের মত প্রেত করতালি আনমনা করে তুলছে তোমায় অথচ দখল ফিরিয়ে নেবে বলে রমণ মাত্রায় উপভোগ করার কথা ছিলো  অতিমারির সুখ...




লক ডাউন

মাস্তুলে আগুন ছিলো আর জলচরের গর্ভ উপচে পড়ছিলো হীরের জাত ভাইয়ের অশ্লীলতায়। তুমি কোন দেবালয়ের দেওয়ালে দেয়ালা বিলিয়ে ফিরছিলে সেই সময় মীরা বাঈ, এ দুনিয়া শুধু নিরোকেই খুঁজে পায় গাল দিতে হলে। তোমার খুব প্রিয় ছিলো আগাছাতে ঢেকে যাওয়া কারশেড, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত রেল বগির জানলা থেকে খুঁজে নিয়ে দেখা, বিধাতা কিছু দৃশ্য মন দিয়ে শোনে। দেখো তোমার ক্ষুদ্র ব্যাসার্ধে নয়, শ্রেষ্ট স্থাপত্য ভাস্কর্যেরা ঢেকে গেছে এখন চরাচর জুড়ে মৃত্যুর শ্যাওলায়। সম্পর্কের থেকে পিছল কোন আঘাটা কোনোদিন ছিলোনা বলে এখন সামান্য শব্দকে লখ্যে পৌঁছতে হলে অতিক্রম করতে হয় ঠিক একটি মানুষের দৈর্ঘ্যের সমান মাপের দূরত্ব। আঙ্গুলে আঙ্গুলে নিরীহ খনিজের চকমকি জ্বেলে ভবিতব্যকে নিয়ন্ত্রণ করত যে বেনিয়া শৃগালের পাল, ভাগ্যোন্নতিকল্পে বিনা পারিশ্রমিকে দৈনিক রাশিফলে তারা পাঠশালার নামতা লিখে চলেছে ডেটল দিয়ে সেই আঙ্গুলগুলোকেই বার বার ধোয়ার । তুুমি কি টের পাওনি আন্তর্জালিক ঘনিষ্ঠতার দায়ে তোমার রক্ত, তোমার হৃদয়- সব কটি জৈব সাম্রাজ্যে সেই কবে থেকে লকডাউন? তোমার বাড়িটার যে কোন স্পর্শযোগ্য স্তম্ভ, আবছা খড়ির দাগ লেগে থাকা ভাঙা সিঁড়িগুলোর দিকে শেষ কবে তাকিয়েছো তুমি  প্রাচীন স্টোভ কম্পানির ঘোষিত অন্ধকার নেমে আসার আগে? নাভিশ্বাস লগ্নে এখন পদ্মপত্রে তরল স্ফটিকের মত থির থির করছে সভ্যতা ও তার ফ্রাঙ্কেনস্টাইন গতি, এই তো সময় জান, ছিদ্রসকলে লকডাউন টেনে ডুব সাঁতারের কেরামতি। 




অলীক ভাইরাস

আফিমের ক্ষেত থেকে প্রজাপতি উড়ে গেলে ডানাগুলো লাট খায়? ঘুমের ভিতর ধীর ঘূর্ণিতে পাক খেয়ে ওঠে মৃত্যু গন্ধবাহী জেগে ওঠার ধূপ। সেনাপতির অশ্ব যুদ্ধ ঘোষণার রাতে কাঁদে কিনা কেউ খুঁজে দেখে? চোদ্দ টি মাটিকে গুছিয়ে রেখে পুরোহিত যখন ফরমান দেয় অপবিত্র কেউ যেন জোগাড়ে না থাকে, তুমি সেদিন মৃন্ময়ী পল্লবের ভিজে যাওয়া দেখতে পাও? এখন দৃষ্টির পরিধি থেকে দুরত্ব মুছে দিচ্ছে অলীক ইরেসার এক, তুমি বলেই যাবে ভাইরাস আর আমি অট্টহাসিতে ফেটে পড়া হাওয়ায় খুঁজে যাবো ধুয়ে যাওয়া কার্বনের ক্ষত? যে শিশু জন্ম নিল আজ অন্ধকার স্তব্ধ এক পৃথিবীতে তার হাসির কর্পূরে নির্জন দেবালয়গুলির শ্বাস দীর্ঘতর হলো। কোথাও এমন প্রস্তর পেলে আমায় জানিও যা হৃদয় প্রতিস্থাপন করতে পারে। ব্যাঙের খোলস পুড়িয়ে তুমি রূপকথা মিলিয়ে দিয়েছ অবিকল। তার কী হয় কে জানে যার ভ্রমরে এখনো কৃষ্ণ দংশনরত... 



কোভিড নেগেটিভ

তুমি সেই উটটা হয়েই থেকে যাবে? আলেয়া যতবার বালির ডানায় চেপে দেখতে বেরোবে হাল হকিকত, একটা গর্তে মুখ লুকোতে গিয়ে যে প্রতিবার দেখতে পাবে কুয়ো আর প্রতিবিম্বে ডুবে যাওয়ার ভয়ে ছিটকে হারিয়ে যাবে শতরঞ্জের ভুল চালের মত। যে মাটিতেই পা রাখতে চাইবে সেই তোমায় বেদি ও দূরত্ব উপঢৌকন দিয়ে বধ করবে শীতল শামুকের মহিমায়? কিছু সরল সত্যকে তরল আগুন করে পুষে বেওয়ারিশ ছাই হয়েই শেষমেষ উড়ে যাবে তুমি? অথচ যতবার কাঁটা উপড়াতে চেয়ে হৃদয় খুঁড়েছ, মাংস বিকিয়েছে চড়া দামে। একটা করে স্বপ্ন ভাঙার ঝণ্ একটা করে আবরণ সরার চেয়েও উল্লসিত করেছে শ্বাপদ সভাকে। চোখের ভিতর কিছুটা বুদ্ধ ঢেলে নিয়ে তুমি কি কুড়িয়ে নেবে এখন ঘুঘুর বুক থেকে খসে পড়া পালকগুলো? আদিম ছায়ায় দাঁড়িয়ে যে মহাপুরুষের সুস্থতা কামনা করেছিলে পরমহংস আলোর কাছে, সে জানতো তোমার পৃথিবীর সব গতি তার আঙ্গুলে জড়ানো, অথচ পরিত্যক্ত সিরিঞ্জে লালা ভরার সময়ে সে তোমার প্রেতের আশেপাশে কোথাও ছিলোনা। সমস্ত লক্ষণ মিলিয়েও তো সংক্রামিত হতে পারলে না। এখনও বুঝবে না এই গ্রহে তুমি একটা এলিয়েন ছাড়া আর কিছুই নও?


8 comments:

  1. অনেকগুলো সিরিজ কবিতাই পড়েছি,তবে এ সিরিজটা মনে থাকবে।হয়ত সময়ের কারণে,হয়ত যন্ত্রণার কারণে,হয়ত...

    ReplyDelete
  2. দারুণ সব লেখা।

    ReplyDelete
  3. ভীষণ ভালো হয়েছে সিরিজটা । একটানা পড়ছিলাম । মনে হল এই সিরিজটা যদি আরো কিছুটা এগতে পারে তা হলে আরও ভালো হয় । একটা ঘোর কাজ করছে সমস্ত লেখাগুলোয় । অসম্ভব ভালো । এই নির্জনতা তার নস্টালজিক পথে আরেকটু এগবে কি ? খুব ভাল হচ্ছে লেখাগুলো ।

    ।। শুভদীপ নায়ক ।।

    ReplyDelete
    Replies
    1. বলছ যখন অবশ্যই চেষ্টা করবো ...

      Delete
  4. প্রতিটি কবিতায় এক ঠাস বুনন।যা সময়কে আক্রমণ করছে,বিষয় কে কোনাকুনি রেখে। ভাব ভাষাকে ভাবনা পরাতে পরাতে কখোনও আয়নার সামনে দাঁড় করাচ্ছে কখনও প্রশ্নে বিদ্ধ করছে। বেশ জোরালো হাত।
    বাক্য গঠনে,সাহসিকতার সঙ্গে দীর্ঘ লাইন নির্মাণ, মিথ, ইতিহাসের টুকরো ব্যবহার, কবিতাশরীরে আঙ্গীকের সাথে সাথে গতানুগতিক রাস্তাকে অস্বীকার করছে।বেশ শক্তিমান কবি। আগে কেন পড়িনি। আফসোস হচ্ছে। তাই এখন সেই ভুল শুধরে কবিকে আমার শুভেচ্ছা। নমস্কার।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনার নাম টি না জানা থাকলেও তাতে বিস্ময়ের ঘাটতি পড়বে না। প্রণাম নেবেন। এমন মন্তব্য অকালেও বোধন আনে। আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানালাম

      Delete