এখন যে বারিকুল থানা,আগে সেখানে জঙ্গল ও কিছু শবরদের ঘর ছিল।মাত্রপাঁচ-ছটা ফ্যামিলি থাকত।আরো
অন্যান্য কয়েকঘর বসতিও ছিল। একটু দূরেই খেজুরখন্ন্যা গ্রাম। এই
গ্রাম পরে বিখ্যাত হয়ে যায়। সেকথাও জায়গাবুঝে বলা যাবে।
আমরা ফুলকুশমা পৌছানোর পরে একটা মিষ্টির দোকান কাম
ভাতের হোটেলে এসে, খাওয়া ও বিশ্রামের
জন্য থামলাম।রাইপুর ও শিলদার মাঝে ফুলকুশমা গ্রাম। খানিকটা গঞ্জ টাইপ। ইতিউতি
ছড়ানো কিছু ঘর আর দোকান। বারোভাজা,মিষ্টি, দু'একটা ভুষিমাল আর একটি কাঁশা-পিতলের বাসনের দোকান।
কাপড়ের দোকানও বোধহয় ছিল, এখন মনেনেই। ঝাড়গ্রাম ও বাঁকুড়া
শহরে যাবার বাস এখান থেকে পাওয়া যায়। তবে বিকেলের পরই সব শুনশান হয়ে যায়। লাল
ধূলোওড়া মোরামের রাস্তা। দক্ষিণ দিকে চলে গেছে শিলদা হয়ে ঝাড়গ্রাম, আর উত্তরে রাইপুর-বিক্রমপুর-শিমলাপাল-তালডাঙরা হয়ে বাঁকুড়া।শিলদা থেকে আরো একটা রাস্তা পশ্চিমে নারায়ণপুর হয়ে চলে গেছে বেলপাহাড়ির দিকে। আমরা যাবো পশ্চিমে।
বাইকটাকেও রেস্ট দিতে হবে। এখানেই "বারিকুলের
ঘাগরায় যাবো " বলতেই লোক এর-ওর মুখের দিকে চায়। একবার আমাদের
দ্যাখে, আর একবার আমাদের বাহনটিকে। সে অনঠিনে কী কাজ গো বাবু?
সুদীপ আমার মুখেরদিকে চায়। আমি ব্যাপারটা বুঝে নিয়েই
বলি, বিড়ির পাতার কারবার আছে। ক্যাঁন্দ
পাতা।
রাস্তা বড়হ খারাপ গ বাবু। তার উপর উখ্যান থি ল্যা
ঘুরে আসতে সাঁঝ হই যাবেক। না যাওয়াই ভালো। তারা ইশারায় বোঝাতে চায়। আরো একটু
খোঁড়াখুঁড়ি করে যা জানলাম, ও পথে দিনে-দুপুরে
রাহাজানি হয়। "লোধাগুলা ভারি বদমাশ গ বাবু। "
এদের কথায় কথায় "বাবু" বলাটা আমার মোটেই
ভালো লাগল না। বহুযুগের সামন্ত-অভ্যাস।শহরের লোক দেখলে এদিক-কার মানুষ অতিমাত্রায়
বিনয়ী হয়ে পড়ে। বিনয় এসব মানুষদের সহজাত ভুষন এটা লক্ষ্য করেছি অনেকবার। কিন্তু
পয়সাওয়ালা বা শহুরে মানুষ দেখলেই এই যে গ্রামীন হীনমন্যতা, এ বিত্তবান ও শহুরে লোকদেরই অপদান।
আমি রাহাজানি হতে পারে ভেবে
সুদীপের দিকে তাকাতে, ও ইশারায় বলল ভয়
নেই। দুখানা মাল আছে ব্যাগে। একটা কালোরঙের ছোট ব্যাগ সবসময়ই ওর টুলবক্সে থাকত। যে
সময়ের কথা বলছি তখন ব্যবসায়ীরাই মোটরসাইকেল ব্যবহার করত। রাস্তাঘাটে পুলিশের এত
চেকিং ছিল না।আমি তখন রিভলবার বা ওয়ান শটার অপারেট করতে শিখে গেছি। অতয়েব নিশ্চিন্ত
হয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে আমরা আবার রওনা দিলাম। ফুলকুশমা থেকে মোরাম রাস্তায় পড়ে কিছুদূর
যাওয়ার পরই ঘন জঙ্গল আর উঁচুনিচু পাথুরে রাস্তায় পড়লাম। জঙ্গলের ভেতর ছোট ছোট বসতি
আর খালের পাশে ধানের খেত। একসাথে দু'তিন বিঘের বেশি জমি কোথাও
নেই। রাস্তায় হাটুরে দু'একটা
মানুষ মাথায় বোঝা নিয়ে চলেছে দূরের কোন গ্রামে। ক্বচিৎ গোরুর গাড়ি ও সাইকেল।
দুপুরের রাস্তায় ঘুঘু পাখিরা মোরামের ধারে বসে থাকে আর হুরুর্ হুরুর্ করে মিষ্টি
সুরে ডাক ছাড়ে। আমরা কাছে গেলেই হাততালির শব্দ করে উড়ে যায়।
বরাগাড়ি, দেবশোল, হাতকাটা,
পেরিয়ে রসপাল ঢোকার মুখে একটা জঙ্গলে ঘেরা বিশাল মহুল গাছের নিচে
ছোট্ট খড়ের ছাউনিবেঁধে হাঁড়িয়ার বিক্রিবাটা চলছে।বিক্রেতা মহিলাটিকে দেখেই বোঝা
যায় কালো চামড়ার নিচে অল্প মেদযুক্ত গ্ল্যামারাস দেখতে উনি সাঁওতাল জাতির। সেখানে জনাকয় লোক সামনে হাঁড়িয়ার বাটি নিয়ে বসেবসে ঝিমাচ্ছে। হাঁড়িয়ার
গুণ। কথা না বললেই ঝিমুনি আসবে। আমরা যখন তাদের কাছে পৌঁছেছি, তখন হয়ত তাদের সমস্ত কথা ফুরিয়ে গেছল। আমাদের দেখে "আয় রে বাবুরা
আয়", বলে কাঠের পিঁড়ে পেতে সে কি আপ্যায়ণ! আসলে দু'বাটি বেশি বিক্রি হবে এই আশা।
আমাদের উদ্দেশ্য ছিল বারিকুলের রাস্তায় ঠিকঠাক যাচ্ছি
কি না জেনে নেওয়া, আর একটু বিশ্রাম।
হাঁড়িয়া দিয়েই জল তেষ্টা মেটালাম। নানা কথার পর ওরাও সেই সাবধানবানী শোনাল।
রাহাজানি।তুদের মটরগাড়ি লিয়ে লিবেক। চাই কি প্রাণে মেরেও ফেলতে পারে।
আমরা অবশ্য সেসব নিয়ে ভাবছি না। জায়গাটা একটা টিলার ধারে জঙ্গলের মধ্যে
হওয়ায় চৈত্র দুপুরের রোদেপোড়া জঙ্গল থেকে নানা সুগন্ধীমিশ্রিত হাওয়া ভেসে বেড়াচ্ছে
চরাচরে। তার সঙ্গে মিশেছে নতুন মহুলকুঁড়ির গন্ধ! হাঁড়িয়ার মিষ্টিমিষ্টি গন্ধ।
শালফুলের গন্ধ। আমরা গন্ধমাতাল আবহাওয়ায় সম্পূর্ণ মদমত্ত হয়ে উঠে ঝিমিয়ে পড়ছি। আমাদেরও
কথা ফুরিয়ে আসছে দেখে সেই মহিলা বলে উঠল, "বাবুরা
ভুঁডরু খাবি?"
আমরা তো হতবাক! হ্যাঁ,খাবো না মানে! নিয়ে এসো।
ভদ্রমহিলা শালপাতার একটা পোঁটলা খুলে আমাদের দিকে
এগিয়ে দিল। বড় কুলের মতো হলুদাভ পাকা ভুঁডরু। অমৃতের মতো তার স্বাদ। এসময়ে জঙ্গলে
অনেকরকম ফল পাকে। চৈত্র থেকে শ্রাবণের মধ্যে ভুঁডরু,পিয়াল, আমরুল, কেন্দ,
আরো নাম না জানা বুনোফল। বনের গভীর কোনো কন্দরে প্রকৃতির নাভির
গন্ধ হয়ে ভেসে থাকে তারা।প্রকৃতি আমার কাছে রহস্যময়ী সেই নারী,অনন্ত অমৃতের ভাঁড়ারী, মানুষ যা চায় সেই সবই সে দিতে
পারগ।শুধু তার মতো হয়ে উঠতে হবে। প্রকৃতিকে ভোগ করতে
হলে সর্বহারা-সন্যাসী হতে হয়। পুজা ও প্রেম মিলিয়ে এমন এক নিখাদ সাধিতমন নিয়ে তার
কাছে যেতে হয় যে নিজের থেকেই সে প্রেমে পড়ে যায়। তারপর সে-ই বাঁচায়, সে-ই উজাড় করে দেয় তার তনুমন। জীবনের অনেকটা সময় ধরে জঙ্গলে থেকে বুঝেছি,
প্রকৃতির কোন খাদ নেই। মানুষ যেদিন থেকে প্রেমে ও পুজায় সাধক হয়ে
উঠবে, প্রকৃতিও প্রতিদান দেবে ষোলআনা। নতুবা তার উল্টোটাই
আমাদের নিয়তি।
সুদীপ বলে ওঠে,
"চ, চ, এখানে
বেশিক্ষণ বসে থাকলে এমনিই মাতাল হয়ে যাবি। ওঃ মনে হচ্ছে স্বর্গে বসে
আছি! আর খানিকক্ষণ থাকলে প্রথম প্রেমের কথাও মনে পড়ে যাবে। শালা,পৃথিবীর কোন ওয়াইনবার এই তুরীয় অবস্থা এনে দিতে পারবে নি রে! এখেনে একদিন
মদ খেতে আসব মাইরি,সত্যি বলছি! "
আমরা উঠে পড়লাম। আপত্তি সত্বেও ভুঁডরু ফলের দাম আমরা দিলাম।
তখন একজামবাটি হাঁড়িয়ার দাম ছিল দু'টাকা। "আবার আসবি বাবু "
সুদীপ বলল,আসব কিন্তু 'বাবু' বলা চলবে
না। ভাই দাদা যা খুশি বল্ মেনে লুব, বাবু বললে আর কুনদিন লয়।
প্রত্যুত্তরে যে শাদা হাসি আমরা পেলাম তা ওই নিখাদ
প্রকৃতিই দিতে পারে। শাল-মহুলের মতো মানুষগুলিও দেদার অমৃতবুকো।
রসপাল ক্যানেলব্রীজ পেরিয়ে আরো ছয়সাত কিলোমিটার পর আমরা
পৌঁছলাম বারিকুল। বারিকুল থেকেও ঘাগরা হয়ে বেলপাহাড়ি বা বাঁশপাহাড়ির দিকে যাওয়া যায়।কিন্তু সে পথ, কেবল সাইকেল,মোটরবাইক, অথবা হেঁটেই যেতে হয়।
রসপালের ক্যানেল ব্রীজে কয়েকজন ষণ্ডামার্কা লোককে
পাথরের মতো বসে থাকতে দেখে এসেছি।আমাদের দেখে ওদের চোখগুলো কেমন চকচক করে উঠেছে
মনেহল।
সুদীপ বলল,আজ
শালাদের পাল্লায় পড়তেই হবে,বুজলি! অরা বসে থাকবে আমাদের ফিরার
আশায়। ভয়ে আমার তো বুক ঢিপঢিপানি বেড়ে যেতে লাগল।
যাইহোক যার সাথে
দেখা হওয়ার কথা সেই তথাগত (নাম পরিবর্তিত) ও আরো কয়েকজনের সাথে আমরা বসলাম। জানলাম,এখানে আসলে এম,সি,সি ঘুমন্ত
অবস্থায় আছে। কয়েকজনের সাথে রাজনৈতিক যোগাযোগ আর পত্র-পত্রিকা দেওয়া-নেওয়া ছাড়া
কোন ইতিবাচক আন্দোলনমুখি মুভমেন্ট নেই। কিন্তু ওরা চায় কিছু একটা হোক। একটা শক্তিশালী
দল গড়ে উঠুক। এখানে ঝাড়খণ্ডীরা শক্তিশালী হলেও সেভাবে
মানুষের মধ্যে কোন আলোড়ন ফেলতে পারে নি। আমরা আমাদের কথা বললাম। আন্দোলনের স্ট্র্যাটেজি
নিয়ে আলোচনা হল। পিপলস্ ওয়ারের জনযুদ্ধ নীতিকে মনে ধরল ওদের। আগামীদিন কীভাবে কী করা যায় সেসব আলোচনা সেরে আমরা উঠলাম। তখন বিকেল গড়িয়ে
গেছে।
ওরা বারবার নিষেধ করল আমাদের ফিরে আসতে। মোটরসাইকেল ছিনতাই
হবেই।যা হোক দুটি খেয়ে রাতটা এখানে কাটিয়ে যাও দাদা, বলতে লাগল। কিন্তু সুদীপ নাছোড়।
আমি মনে মনে ভাবলাম ওর মাথায় কোন ফন্দি আছে। সে টা কী, তা জানি না, কিন্তু
মন বলছে দারুন রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চার হতে চলেছে।
যা ভেবেছিলাম, তখন সন্ধ্যে হব হব। রাস্তায় জনপ্রাণী নেই । জঙ্গলাকীর্ণ রসপাল ক্যানেলব্রীজে ওঠার আগেই
বনের মধ্যে থেকে সিটি বাজানোর শব্দ হল। সুদীপদা খানিকটা এগিয়ে বাইকের স্টার্ট বন্ধ
করল।ব্যাগ থেকে রিভলবার বের করে কোমরে গুঁজল আর আমাকে দিল ওয়ান শটারটা। তাতে একটা
লোড পয়েন্ট থ্রি-ফিফটিন বুলেট,আর গোটা চার
রাখলাম পকেটে । আলো-আঁধারির মধ্যে কয়েকটা লোক জঙ্গল থেকে ভুতের মত উঠে এল রাস্তায়।
আমরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে চারিদিকে নজর রেখেছি।
সুদীপদা আগেই বলে রেখেছিল কোন ভাবেই খুব বিপদ না
দেখলে গুলি চালাবি না। মারতে এলে পায়ের দিকে চালাবি তাও না লাগলেই ভালো। লোকগুলো
খুবই গরীব। কাজ পায়নি বলেই ছিনতাইএর লাইন ধরেছে। কিন্তু ওদেরকে পালাতে দেওয়াও চলবে
না। দরকার আছে লোকগুলোকে। ওরা কোন আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে না। অত পয়সা ওদের নেই।
টাঙ্গি, কুড়াল, তাবলা, ও বল্লমের উপর ভরসা করেই কাজ চালায়।
জায়গাটার একটা দিকে ঢালু জঙ্গলময় খাল, আর অপর দিকে অনেকটা বিস্তৃত বনভূমিছাওয়া কাছিমের
পিঠের মতো চ্যাটালো টিলা। এখানে কাউকে মেরে ঝোপঝাড় আচ্ছাদিত খাদের নালায় ফেলে
রেখে গেলে সারারাতে বন্যজানোয়ারে তার আর চিহ্ন রাখবে না। রাহাজানির পক্ষে সাতিশয়
অনূকুলস্থান।
সেদিন ঠিক কী ঘটেছিল তা সবিস্তারে এবং নিখাদ বর্ণনায়
আমি পাঠককে বোঝাতে পারবনা। তবু স্মৃতির কোটর হাতড়ে ঘটনাটির একটি অভাবি-চলচ্চিত্র
তৈরির চেষ্টা করা যেতে পারে।
ওরা সামনে ছিল তিনজন আর পিছনে চারজন।ওদের কাজ হল
পরিস্থিতির বিচার করে দল তৈরি করা।আমাদের দুইজনের জন্য ওদের সাতজনই কাফি। প্রথমেই
ওরা বাইক বা গাড়ি যাই-ই থাক সেটাকে আটকায়। বাইক হলে রাস্তার দু'পাশের গাছে টান করে তার বেঁধে রাখে। গাড়ি বা
বাস হলে গাছকেটে রাস্তায় ফেলে দেয়।আমাদের আসতে দেখেই গাছেপাতায় ঠ্যাঙা-ঠেঙি করে,
ঝটর-পটর শব্দ তুলে একটা ভয়াল পরিবেশ গড়ে তোলে। এতেই পথচারীরা
হকচকিয়ে যায়। তারপর ভয়ঙ্কর হুলুহুলু শব্দে সমবেত কুলকুলি দিয়ে তেড়ে এগিয়ে আসে।তাতে ভিক্টিম্ হতভম্ব হয়ে পড়ে। শিকার
রাজ্যে এই হিপনোটিজমের ফলেই শিকার অনেকটা কব্জা হয়ে যায়।
আমাদের বেলায় ঠিক এরকমটা না ঘটলেও, গাছেপতায় ঝোপেঝাড়ে লাঠির বিটিং করতে করতে
ওরা এগিয়ে এল, যাতে মনে হয় সংখ্যায় ওরা অনেক বেশি।
একজন বলছিল, গাড়িটা আর টাকাপয়সা যা আছে দিয়ে দে। নইলে
কাট্যে রাখে দিব।রক্তগঙ্গা কইরব! বুঝলাম,এই হাঁক শুনেই
পথচারীরা প্যান্ট হলুদ করে ফ্যালে। আমারও প্রায় হয়ে এসেছিল, কন্ঠার
কাছটা টনটন করছিল আর তলপেটে প্রচন্ড চাপ, আর একটু হলেই... । গোটা ঘটনাটা ঘটতে মিনিট দশেকের বেশি সময় লাগে নি।
ওরা আমাদের কাছে এসে পৌঁছলে আমরা অস্ত্রগুলো
বের করলাম।আমার হাত এতটা কাঁপছিল যে হাত থেকে বন্দুক ছাড়িয়ে নিয়ে চিনি আর জলদেওয়া
গ্লাস ধরিয়ে দিলে শরবত হয়ে যেত ।অন্ধকার খুব ঘন ছিল না বলে আমাদের হাতের
অস্ত্রগুলো দেখা যাচ্ছিল। আমার মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ করে একটা আওয়াজ বেরোচ্ছিল! বোধহয়,
হাঁটুতে প্রচুর সাহস জমা হয়ে গলা আর নাক-মুখ দিয়ে তার রিয়্যাক্শন
বেরুলে এরকমই আওয়াজ হয়!!
হঠাৎ
সুদীপ বলে উঠল ,"খবরদার!
আমাদের কাছে বন্দুক আছে। কেউ পালাবি না। মেরে লাশ ফেলে দেব।"
লেঃ লুলু!
এ ক্যামনধারা কথারে বাপ্। লোকে তো বলে খবরদার কাছে আসবি না! এ বান্দা বলে কি না, "কেউ পালাবি না"!
এইজন্যই এদের বোধহয় নকশাল বলে।
সুদীপদা কথাগুলো
একটু জোরেই বলেছিল। আর তাইতে প্রচণ্ড উত্তেজনায় আমার ওয়ান শটার ফায়ার হয়ে গেল
গদাম্ করে! উরিব্বাস! ফুটাগুলির সে কী গগনবিদারী শব্দ ! কোথাকার গুলি যে কোন দিকে ছুটল সে রামা-ই জানে!
ঘটনার আকস্মিকতায় সুদীপদা হতভম্ব হয়ে নুয়ে গেল,প্রায় বসে পড়ার মতো ভঙ্গি, আমার দিকে রসগোল্লার মত চোখ করে তাকিয়ে আছে। রাইফেলের গুলি ওয়ানশটার থেকে
বেরোলে যা হয়। সে আওয়াজ তো নয় যেন বাজ পড়ল! আমার কব্জিতে
রিকোয়ালিঙের প্রচণ্ড ধাক্কায় ব্যথা হয়ে গেল। ভোঁস করে কতকটা বারুদমেশানো ধোঁয়া
নাক-মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। বোধহয় ফায়ারের সময় ঢুকে থাকবে। না কি অত্যধিক উত্তেজনায়
পেটের নাড়িভুঁড়ি পুড়ে ধোঁয়া হয়ে গেল কে জানে! আরেঃ খেয়াল হতে দেখি সদ্য গুলি ওগরানো ধোঁয়াওঠা নলটা নুয়ে পড়া সুদীপের বুকের দিকে তাক করা! কাঁপা হাতের সঙ্গে সেটা মাথা নেড়ে নেড়ে ওকে যেন বলছে কেমন দিলাম রে গুরুভাই !
একটা লোক উঃ শব্দ করে মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল । তাই
দেখাদেখি বাকিগুলোও রাস্তার উপর মাথায় হাতঢাকা দিয়ে উবু হয়ে বসে পড়েছে। তখনো আমার বোধগম্য হয়নি যে গুলিটা গেল কোনদিকে! শালা সুদীপদাকেই লাগে নি
তো!
আমি আর থাকতে না পেরে সুদীপদাকে জোরে ঝাঁকাতে যাব,"ও গো কী হল গো সুদীপদা,তোমার বাপ যে আমাকে মেরে গোয়ালঘরে পুঁতে রাখবে গো!
", বলে সর্বহারার কান্না কেঁদে উঠতে যাব, এমন সময় দেখি সে ষণ্ডা আমার দিকেই রিভলবার তাক করে বলছে, "আজ তোকেই মেরে ফেলব, শালা, আর
একটু হলেই তো আমাকে ভোগে পাঠিয়ে দিচ্ছিলি, হারামজাদা!"
যাক গুলিটা তাহলে সুদীপদাকে লাগে নি। কিন্তু রাগ করে
সে বিবাগী গুলির-ব্যাটা গেল কোনদিকে!
রাস্তায় পড়ে থাকা লোকগুলো তখন, "ওগো আর গোলাগুলি চালাবেনি গো
বাপ-দাদারা! আর কুনদিন এমন হবে নি গো! " বলে শুয়ে বসেই চিকুড় পাড়তে লাগল।
সুদীপ তাদের মধ্যিখান থেকে টাঙি, তাবলা,তলোয়ার কুড়িয়ে নিতে নিতে বলল, নাঃ তোর গুলিটা বেকার
যায়নি রে খ্যাপা। হাঁ দ্যাখ! বলে আমার দিকে একটা ভাঙা বল্লম এগিয়ে দিল।
দেখলাম, যে লোকটা প্রথমেই উঃ বলে শুয়ে পড়েছিল, আমার ছোঁড়া বুলেট,
তার হাতে ধরা বল্লমটার কাঠের হাতলে লেগে সেটাকে দু'ভাগ করে দিয়েছে। আর তার ভয়েই সে ব্যাটা উঃ করে শুয়ে পড়েছে। হে হে ,
ঝড়ে কাক মরল আর ফকিরের ক্যারদানি বাড়ল!
পরক্ষণেই মনে হল ভাগ্যিস গুলিটা বল্লমে লেগেছে। না
হলে যে উচ্চতায় ওটা ছুটে গিয়েছিল, তাতে
একটু এদিক ওদিক হলে লোকটার কোমরে বা তলপেটে লাগতে পারত। তাহলে সত্যি সত্যিই
রক্তগঙ্গা বইত!
ভয়পাওয়া আনাড়ি শিকারীর ততোধিক আনাড়ি গুলির হাত থেকে বড়
বাঁচা বেঁচেছে বেচারা।
আসলে বিপরীতের প্রতিক্রিয়াটা এভাবে আসবে ভাবতে পারেনি
ওরা।ভেবেছিল, বিড়ির পাতার
কারবারি এরা, অল্প হুঙ্কারেই কাবু করা যাবে। আরো একটা
ব্যাপার হল এরা পোড় খাওয়া ডাকাত হলেও বন্দুক-পিস্তল জাতীয় আগ্নেয়াস্ত্রের বিষয়ে
একেবারেই অনভিজ্ঞ। পুলিশের হাতে বন্দুক থাকে বলেই পুলিশকে এরা ভয় পায়। যে-সময়ের কথা বলছি তখনো কেশপুর-গড়বেতা ঘটেনি।মানুষেরকাছে আগ্নেয়াস্ত্র
তখনো ভয়েরই বস্তু ছিল।
বস্তুতঃ গড়বেতা কেশপুর নানুর আরামবাগের সিপিএম-বিরোধী
উত্থানের পরেই সাধারণ মানুষ বন্দুক-পিস্তলকে মুড়িমুড়কি বানিয়ে ফেলেছে। দশ-বছরের বাচ্চাও
আজকাল পেটো বাঁধতে পারে, এটা কোন অত্যুক্তি
নয়। কোনরকম বোমা বন্দুকই আজকের মানুষের কাছে আর
ভয় আনে না। কিন্তু সেদিন আমাদের হাতের দেশি হ্যান্ডমেড
বন্দুকই ওদের কাছে বিভীষিকা হয়ে দেখা দিয়েছিল।
এমন একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনায় মিইয়েযাওয়া লোকগুলিকে
নিরস্ত্র করে সারদিয়ে বসানো হল রাস্তার পাশে। তারপর সুদীপদা বলল,আমরা পুলিশ-টুলিশ নই বাপু। আমরা নকশাল।
তোমাদের কোন ক্ষতি করব না। আমাদের রাজনীতি করলে, তোমাদের আর
এই ডাকাতি, রাহাজানি করতে হবে না।সাধারণ গরীব মানুষের
মেহনতের দু'পয়সা ছাড়িয়ে কেন পাপ বাড়াবে বাছা।পাপ যদি করতেই
হয় তো বড়লোকের ছাড়িয়ে গরীবকে বিলি করে কর। ইত্যাদি বলে লোকগুলোক কিছুটা
ধাতস্থ করা হল। মন দিয়ে তারা আমাদের কথা শুনল। সুদীপদা'র এই একটা গুণও ছিল, যে
কোথায় কোন স্থানে কোন পাত্রের কাছে কী ভাবে কথা বলতে হয়। এদের কাছে কমিউনিস্ট তাত্বিকতার
(যে শব্দবন্ধগুলি দুই মলাটের ভেতর আবদ্ধ থাকে) কথা বললে উলুবনে মুক্তো ছড়ানো হবে।
আমিও এই টেকনিকটা সুদীপদা'র কাছ থেকেই
শিখেছিলাম। তাতে সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষের কাছে আসার সুযোগটা বেশি পেয়েছিলাম।
বারিকুলের তথাগতের
সাথে যোগাযোগ করতে বলে আর ওদের নামধাম জেনে নিয়ে, আমরা ফিরে
চললাম।সর্দার গোছের লোকটা আমাদের একটা ঠিকানা দিল, রাইপুরের।আমরা
রওনা হওয়ার আগে রাস্তার উপর এক গাছ থেকে আর এক গাছে ওরা তার বেঁধে রেখেছিল,সেটা খুলে নিল। অর্থাৎ আমরা যদি খুব স্পীডে বাইক চালিয়ে পালাতে চাইতাম তাহলে
গলায় তারের ঘষা খেয়েই পড়ে যেতাম আর ওরা আমাদের মেরে বাইক ছিনতাই করে নিত।
সেদিন চল্লিশ কিলোমিটার আসার পর রাইপুরেই তার
স্যাঙাতের আস্তানায় আমরা রাতটা কাটিয়েছিলাম। পরে এই স্যাঙাৎও আমাদের দলে নাম
লিখিয়েছিল।
তারপর সারা পথ বাইকে আসতে আসতে বুঝেছিলাম,কেন সুদীপদা বলেছিল,"খবরদার,কেউ পালাবি না "! লোকগুলোকে বড় দরকার ছিল আমাদের।
ক্রমশঃ
অস্ত্র আমাদের ভয় দেখায়। অস্ত্র আমাদের শক্তি দেয়। অস্ত্র আমাদের মাঝে ব্যবধান গড়ে তোলে, যাকে আমরা ব্যক্তিত্ব ভেবে পুলকিত অথবা শিহরিত হই। অস্ত্র বন্ধু বানাচ্ছে--- অথচ যাদের হাতে অস্ত্র তারা কি ভীষণ মানুষ! কি সৎ তাদের অস্ত্র হাতে রেখেও অস্ত্রবিরোধিতা এবং আশঙ্কা, ভয়।
ReplyDeleteভয় পাওয়ানোতে আসলে যে কোনও ব্যক্তিত্ব নেই,বাবু ডাক শোনাতে যে আসলে যে কোনও মর্যাদা নেই,বরং লজ্জা আছে--- এ অনুভবের সাথে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েও এ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কাছে নতজানু হয়ে বসে থাকি।
ঠিক Sruti আপনি বিষয়টা বুঝেছেন।এসবই আসলে ওই মানুষগুলোর কাছ থেকে শেখা।যারা অস্ত্রকেই শক্তির উৎস বলে মনে করে, তারা আসলে ভিতু,মানুষের ভেতরেই অনন্ত ক্ষমতার কেন্দ্র।
Deleteবেশ ভালো লাগলো
ReplyDeleteনাহ্, 'অসামান্য', 'অসাধারণ' এসব ক্লিশে হয়ে যাওয়া প্রশংসা শব্দ লিখতে চাইনা। এ লেখা তা দাবিও করে না সম্ভবত।
ReplyDeleteএই পাঠ এক যাপনকথাকে সামনে এনে দেয়। যা অনুভবের, ভাবনার জগতকে নাড়া দেয় সমূলে। আবার পড়ব। তবে সম্পাদনার প্রয়োজন আছে। টাইপিং এর সাধারণ ভুল যা মূলত অসাবধানতার ফলেই ঘটেছে, এড়াতে পারলে ভালো হয়।