বাক্‌ ১৪২ ।। এই সংখ্যার কবি ।। ফরিদ কবির



"কবিতা হলো এমন পঙক্তি বা পঙক্তিগুচ্ছ যাতে আছে বহুমাত্রিক অর্থ বা ভাবনা। যা পাঠককে উত্তেজিত করতে পারে, উদ্দীপিত করতে পারে, প্রণোদিত করতে পারে, নিরুত্তেজ বা অবশও করে দিতে পারে। জাগাতে পারে প্রেম, এমনকি ঘৃণাও।" -ফরিদ কবির


কবি ফরিদ কবিরের জন্ম ২২শে জানুয়ারি ১৯৫৯, ঢাকায়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক। প্রাতিষ্ঠানিক পেশা সাপেক্ষে বলা যায়, কবি ব্যাংকে ৩ বছর চাকুরির পর পরবর্তীতে প্রায় দশ বছর ৩টি দৈনিক কাগজে সাংবাদিকতা করেছেন। বর্তমানে তিনি 'বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির অন্যতম পরিচালক। তাঁর কাছে "যিনি কবিতা লেখেন, তিনিই কবি"। বাংলা ভাষায় কবিরের প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জীবনানন্দ দাশ এবং বিদেশি ভাষায় শার্ল বোদলেয়র ও টিএস এলিয়ট। 




গ্রন্থ


কবিতা

| "হৃদপিণ্ডে রক্তপাত" ('মুক্তধারা' ১৯৮৫) 
| "ওড়ে ঘুম ওড়ে গাঙচিল" ('পল্লব পাবলিশার্স' ১৯৮৮) 
| "অনন্ত দরোজাগুচ্ছ" ('অনন্যা' ১৯৯১)
| "মন্ত্র" ('অন্যপ্রকাশ' ১৯৯৯)
| "ওঁ প্রকৃতি ওঁ প্রেম" ('আগামী', ২০১১)
| "নির্বাচিত কবিতা" ('অন্যপ্রকাশ' ২০০৩, 'অঙ্কুর' ২০০৭, 'ঐহিক' ২০১৮) 
| "প্রেমের কবিতা" ('বিদ্যাপ্রকাশ', ২০০৯)
| "আমার কবিতা" ('অনন্যা', ২০১২)
| "ফরিদ কবিরের কবিতা/পোয়েমস অব ফরিদ কবির" ('অন্যপ্রকাশ', ২০১৬)
১০| "শ্রেষ্ঠ কবিতা" ('সূচীপত্র', ২০১৭) 
১১| "প্রেমমন্ত্র" ('পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড', ২০২০)  

প্রবন্ধ

| "পুরোনো ও নতুন কবিতা এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ" ('অন্যপ্রকাশ' ২০০৩)
| "আমার গদ্য" ('অ্যাডর্ন', ২০১৫) 


আত্মজীবনী


"আমার গল্প" ('আগামী', ২০১৭) 


সম্পাদনা

| "নির্বাচিত কবিতা" ('সিনোরিনা' ১৯৮৪)
| "পঞ্চাশ বছরের প্রেমের কবিতা" ('মুক্তধারা' ১৯৮৬)
| "কবিদের লেখা প্রেমের গল্প" ('কাকলী' ১৯৮৭, 'অন্যপ্রকাশ' ১৯৯৯)
| "দুই বাংলার কবিতা" ('পল্লব পাবলিশার্স' ১৯৮৭) 
| "একুশের গল্প" ('অনন্যা' ১৯৯১)
| "একুশের কবিতা" ('অনন্যা' ১৯৯১)
| "হৃদয়ে আমার বাংলাদেশ" ('অনুপম প্রকাশনী' ১৯৯২)
| "দুই বাংলার শ্রেষ্ঠ গল্প" ('শিখা প্রকাশনী' ১৯৯৩)
| "স্বাধীনতাযুদ্ধের স্মৃতি" ('মাওলা ব্রাদার্স' ১৯৯৪)
১০| "দুই বাংলার ৫০ বছরের প্রেমের কবিতা" ('অন্যপ্রকাশ' ১৯৯৮)  

অনুবাদ

| "বাংলাদেশ: একটি রক্তাক্ত দলিল" ('বন্ধু' ১৯৮৭, 'হাওলাদার প্রকাশনী' ২০১৫)
| "মুক্তিযুদ্ধের ঘাতক" ('পল্লব পাবলিশার্স' ১৯৮৯) 







কবির এক গুচ্ছ কবিতা
                           

ট্রেন

ট্রেন আমাদের নামিয়ে দিয়ে গেল
মাঝপথে, অচেনা স্টেশনে

মানুষ যেখানে যেতে চায় সেটাই কি গন্তব্য?
নাকি, তারা যেখানে নামে?
নাকি, গন্তব্যই খুঁজে নেয় তার নিজস্ব মানুষ!

বিহ্বল স্টেশনে নেমে আমরাও ভাবি-
এখানেই কি নামতে চেয়েছি
নাকি, ট্রেনই নামিয়ে দিয়ে গেছে আমাদের
           এই ঘন কুয়াশারাত্রিতে!

যেখানে নেমেছি, কিংবা যেখানে যাওয়ার কথা ছিল
কিছুই আসলে সত্য নয়

আমাদের চোখের সামনে শুধু ছবি হয়ে থাকে
                                ট্রেনের জানালা
আর, খুব দ্রুত ছুটে চলা যমুনা ব্রিজ...



সাপ-লুডু


সাপ-লুডু বেশ বিপজ্জনক!
খেলতে গেলেই দেখি, সাপগুলি জ্যান্ত হয়ে যায়
ছোবলের ভয়ে আমি লুডুর এ-ঘর থেকে অন্য ঘরে
ক্রমাগত ছুটতে থাকি!

ওপরে যাওয়ার জন্য মইগুলি খুঁজি
একটু আগেও পড়ে ছিলো, যত্রতত্র

কিন্তু তোমাদের মধ্যে কেউ একজন
সিঁড়িগুলি সরিয়ে ফেলেছো

আমি যে ধরবো, নেই তেমন একটা হাতও
অথচ পাশেই ছিলে তুমি
অথবা তোমার মতো অন্য কেউ!

সাপগুলি আস্তে আস্তে ঘিরে ফেলেছে চারপাশ থেকে
আর, আমি ছোবল খাওয়ার জন্য তৈরি হতে থাকি... 






আয়না 


আমি দেখি?
নাকি আয়নাই আমাকে দেখায়?
নিজেকেই দেখছি হয়তো
যদিও সামনে যাকে দেখি- দেখতে আমারই মতো
কিন্তু আমি নই

কেননা, আমি তো মৃত 
বিধ্বস্ত আমার মুখ, ভয় দুই চোখের পাতায়

আয়না রহস্যময়, ভার্চুয়াল আরেক দুনিয়া
সেখানে আমার বিম্ব বরাবর ঝকঝকে, জীবন্ত 
বরং কিছুটা স্মার্ট 

যেমন আজ সে বাইরে এসেই
আমাকে পাঠিয়ে দিলো আয়নার ভেতরে

আয়নার ওপাশে ভয়ানক অন্ধকার
অথচ এপাশ থেকে সব সময় উজ্জ্বল দেখায়!  



গণিত 

গণিত বড়ই রহস্যময় 
শেখায় দুয়ে দুয়ে চার... 
কিন্তু বাস্তবে এ হিসাব কখনো মেলে না
দুয়ে দুয়ে ২, ৩ এমনকি  
৫ কিংবা ৭ হয় 
৪ কিছুতেই নয় 

কী কী বর্ণ যোগ অথবা বিয়োগ করলে
অংকটা মিলবে, জানা নাই  

আমি দুয়ের সঙ্গে ২ যোগ করি, ৩ যোগ করি  
লাল এমনকি নীল যোগ করি 

তুমি দুই থেকে দুঃখ বিয়োগ করেও পাও ৫ অথবা ৭
আমি দুয়ের সঙ্গে তোমাকে যোগ করেও ২ অথবা ৩

বিয়োগ করলেও তোমার যোগফল মেলে
আমি যোগ করলেও বিয়োগফল

আমি দুয়ে দুয়ে পাই ২ বা ৩
তুমি ৫, ৭ কিংবা ৯ 

একথা তো আজ বলতেই পারো 
দুয়ে দুয়ে তুমিও চারই চেয়েছিলে 
, , ৯- কিছুতেই নয়... 



শূন্য


এক শূন্য থেকে ঢুকে যাচ্ছি 
        অসংখ্য শূন্যের মধ্যে
আর, সরে যাচ্ছি ডান দিকে, ক্রমাগত
মানে, অন্ধকারে...
মানে, কিছুক্ষণ আগেও তুমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলে
ফোঁটা ফোঁটা আলোকবৃষ্টিতে...

আদ্যোপান্ত যেন এক বাতাসপ্রতিমা,
ছড়িয়ে চলেছ বর্ণহীন কিংবা
বর্ণিল বুদ্বুদ, চারপাশে 

তবু আমি নিঃশ্বাসে তোমাকে নেই
প্রশ্বাসে নিজেকে ছাড়ি

শূন্যে... 



ফুল

ঘ্রাণেই সম্পূর্ণ স্নান, তবু খোঁজো তুমি জল-সাবানের ফেনা

কী আছে রোমাঞ্চ স্নানঘরে
চামড়ার নিচে যদি রয়ে যায় অন্ধকার
আর, কালো ময়লার স্তূপ
সহস্র বুদবুদ থেকে ফিরে 
কীভাবে নিজেকে ভাবো তুমি শতভাগ পরিষ্কার

যে-কারণে বলি, ফুলই প্রকৃত সমুদ্র
কেননা, তাকেই আমি ঘ্রাণসহ বর্ণিল রেখেছি

কাঁটার সংঘাতে যদি ঝরে কিছু রক্তের গরম
তুমি কাটো সাঁতার গোলাপে
আর, পাপড়ির বর্ণে করো জন্মোৎসব 

আজ বলি, ঘ্রাণের জন্যই 
এতোকাল পুষ্পপূজা নিষিদ্ধ করিনি 




ঘ্রাণ

তোমার ঘ্রাণেও আছে আলাদা সৌন্দর্য
সামান্য কথার পর সমুদ্র-দূরত্বও যেন নিমিষে উধাও
আর, সেই ঘ্রাণ এসে মিশে যায় আমার শরীরে

দ্বৈত গন্ধ নিয়ে আমি উন্মাতাল
যেন এইমাত্র শেষ হলো সম্পূর্ণ সঙ্গম
তোমার রঙিন ঘ্রাণ টের পায় এতো দূরে গাছের পাতাও

আজ বুঝি- রূপে নয়, ঘ্রাণে আছে সকল রহস্য
এর টানে ফুলের কাছেই 
বারবার ফিরে যায় সকল মৌমাছি

নিজেকেও মৌমাছি বলেই মনে হচ্ছে আজ
ঘ্রাণ থেকে খুলে নিচ্ছি অসামান্য মধু... 






পরিস্থিতি-৬

টোকা দিলে শব্দ হয় শূন্যে
বিভ্রম কাটেনি, এই ভয়ে চুপচাপ বসে থাকি
পকেটে অগ্নির বাক্স খুঁজতে গিয়েই এতো বিপত্তি বেঁধেছে

বারবার উঠে আসে তোমার আঙুল 
তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে
চুম্বন-মুহূর্তে আমি সতর্ক থাকি না
তোমার একটি চোখ আমার পেটের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলো

এখন শরীরভর্তি চোখ
পেটে, পিঠে, হাতের তালুতে 
ফলে আমি বাইরে বেরোলে তুমি সব দেখতে পাও

কিন্তু তুমি বেরোলেই আমি কিছু দেখতে পাই না
তুমিও তো আমার একটা চোখ খেয়ে ফেলেছিলে! 



বাড়ি

একটি বাড়ির দিকে উঁকি দিলো আরেকটি বাড়ি
ভেতরে মানুষ নেই, সিগারেট ঠোঁটে 
বসে আছে জানালার কাঁচ 
বুক-শেলফ হেঁটে গেলো পয়মন্ত চেয়ারের দিকে
দুলছে চেয়ার 

বিছানায় শুয়ে আছে বালিশের প্রেত
জানালার পাট চোখ তুলে
দেখে নিলো চন্দ্রের আলোকে
মৌমাছির মতো টেবিলের ওপর উড়ছে ঘুম
ডায়েরির পাতা 

কার্নিশে কার্নিশ ছুঁয়ে শাদা বাড়িটিকে 
চুমু খেলো দোতলা বাড়িটা

বাড়িতে কেউ কি আছে? সারা রাত জেগে
খুব ভোরে ঘুমিয়ে পড়লো আলনায় ঝুলে থাকা
মুণ্ডুহীন শার্ট
পা কোথায়? হাতের আঙুল?
বাতাসে ডানার গন্ধ, আর 
বাড়ির ভেতরে ফিসফিস
হাত-পা আঙুল খুলে আলনায় ঝোলে মুণ্ডুহীন শার্ট
একবার শুধু বুক-শেলফ
হেঁটে গেলো পয়মন্ত চেয়ারের দিকে
দুলছে চেয়ার
মৌমাছির মতো
টেবিলের ওপর উড়ছে ঘুম, ডায়েরির পাতা

একটি বাড়ির দিকে হেঁটে এলো আরেকটি বাড়ি... 




শরীর 

বন্দি নয়, তোর হাত নিজে এসে আশ্রয় নিয়েছে
এই করতলে
তোর কাছে নিরাপদ নয় কোনো কিছু
তোর হাত, হাতের আঙুল 

সামান্য যে গাছ, সেও অরক্ষিত রাখে না পাতাকে
তুলে ধরে যতোটা সম্ভব শূন্যে, স্পর্শের বাইরে
যে কারণে পাতা থাকে নিতান্ত সবুজ

স্পর্শাতীত কিছু নেই তোর
যে রকম হাতের ইশারা বুঝে তোর হাত 
ঢুকে পড়ে আমার মুঠোয়
কথা হয় আঙুলে আঙুলে 

শরীরও যথেষ্ট জ্ঞানী তোর
ভাষা বোঝে আরেক দেহের...  



অপ্রকাশিত কবিতা

সে 

প্রতিটি মুহূর্ত ঠিক কাঁটার মতোই 
বিদ্ধ করে যাচ্ছে হৃদপিণ্ড বরাবর। 
বেঁচে আছো, তবে হাঁটু মুড়ে, মুত্যুরই সামনে।

কেউ আছে, দরজার ওপাশে! 
কে জানে বন্ধুর ছদ্মবেশে ভেতরে ঢুকেই 
তছনছ করে দেয় কি না 
দেয়ালপঞ্জিকা! 

জানালা-দরজা সব বন্ধ 
তবু ভয়, বাতাসের পোশাকে সে 
এসে মিশে যেতে পারে শরীরে শরীরে! 

কীভাবে থামাবে তার এই চলাফেরা, 
নিঃশব্দ গতিকে? 
সে একাই টেনে দিচ্ছে কৃষ্ণ চাদরসমূহ 
অক্ষরেখাজুড়ে! 

ভাবো একবার, চোখ বুঁজবার আগে আশেপাশে 
প্রিয়মুখগুলো নেই! নেই হাতের নরম স্পর্শও। 

কেবল অসংখ্য মাছি উড়ে যাচ্ছে দিগন্ত অবধি...


বৃষ্টির শব্দ


বৃষ্টি নেই! 
তবু কানে বৃষ্টির আওয়াজ!
 যেন সে নাচছে। 
এই তো! স্পর্শের দূরত্বে 
আমরা কি বৃষ্টি দেখি? নাকি, শুনি তাকে?

বৃষ্টির শব্দেও জাগে রঙিন বিভ্রম 
শব্দমাত্র চোখের সামনে 
অবিকল ঝরতে দেখি তাকে 
তার একটা-দুটো ফোঁটা ছিটকে এসে 
বসে পড়ে ঠিক নাকে, কিংবা ঠোঁটের কোনায়। 
যৎসামান্য জলকণা। 
তবু প্ররোচনাময়। 
আমাকেও নিয়ে যায় নিজের কাতারে। 

বৃষ্টির তুমুল শব্দে আমিও ঝরছি আজ অবিরাম। 
অচেনা উঠানে!




2 comments:

  1. সুন্দর কবিতা গুলি ।

    ReplyDelete
  2. আবারো প্রিয় কবির কবিতা পড়ে মুগ্ধ 🌿

    ReplyDelete