বাক্‌ ১৪২ ।। সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায় ।। তপোভাগ ত্রয়োদশ পর্ব




সম্মোহন, আত্মসম্মোহন, শরীর, রসবেদন :

প্রণয়ের কথায় শুধু পুরুষই নারীকে ভোলায়না, নারীও নিজেকে ভোলায়।
শরীরে একটু উষ্ণতা সয়না পদ্মাবতীর। বায়ু সামান্য উষ্ণ হলেই তাঁর অসহ্য লাগে, ছটফট করতে থাকেন তিনি। কমবয়সে তবু সহ্য করতে পারতেন। যতো বয়েস হচ্ছে ততো এ পীড়া অসহ্য বোধ হচ্ছে। বিশেষতঃ ঋতুনিবৃত্তির পর থেকে তার কিছু কিছু শারীরিক পরিবর্তন হয়েছে। যে কোনো ঋতুতে গায়ে বসন রাখলে তাঁর অঙ্গ জ্বলে যেন। চিড়বিড় করে গা। প্রাসাদের বৃহৎ আয়তনে থাকতে তার অসুবিধে হয়। নিষাদী কিঙ্করীকে নিয়ে তিনি কাননমধ্যস্থ কুটিরে বাস করেন প্রায়সময়। রাজপ্রাসাদে গাছপালা নেই। কাননের এই কুটিরের চারদিকে ছায়াঘন বৃক্ষাদি, ফলে কুটিরে এক শান্ত শীতল ভাব রয়েছে। অঙ্গ জুড়ায় তাঁর এখানে। অক্রুরও যে কয়বার এসেছে, এখানেই এসেছে।

- আদেশ করুন দেবী।
- ও আবার কি? রঙ্গ হচ্ছে নাকি?
- রঙ্গ কেন? আপনি রাজ্ঞী। বয়েসে সম্মানে এতো বড়ো! দেবী সম্বোধন করাটা কি ভুল হলো? নাকি আদেশের কথাটা ভুল?
- কি জন্য আমি দেবী? রাজ্ঞী বলে? বয়েসে বড়ো বলে? সম্মানে বড়ো বলে? নাকি প্রিয়তমা বলে?
- প্রিয়তমা?
- নই?
- কখনো কি বলেছি তা?
- কেন বলোনি? আমাকে প্রিয়তমা বললে কি তোমার যৌবনের মান যায়?
- অসত্যভাষণ হয় মহারাণী। আমি কখনোই তোমার প্রণয়াকাঙখী ছিলাম না। এখনো নই। পরেও থাকবোনা।
- আবার শুরু করলে?
- কে শুরু করলো? আমি করলাম, না তুমি?
- আমার কি শুনতে সাধ হয় না?
- আমার তো মিথ্যাভাষণের সাধ হয়না দেবী! বলতে পারলে আমি বলতাম। কিন্তু মিথ্যা সন্তোষ দিতে প্রবৃত্তি হয়না।
- তবে আসো কেন?
- আমি আসি? না, আনীত হই?
- কখনও কি তোমার ইচ্ছা হয়না?
- বুঝতে পারিনি দেবী। বুঝবার অবসর পাইনি। তুমি দাওনি অবসর।
- আমি দিইনি অবসর?
- উঃ বিরক্তিকর হয়ে উঠো না। তুমি দাওনি অবসর, এ কি তুমি জানোনা, যে বুঝিয়ে বলতে হবে? হ্যাঁ, তুমিই দাওনি অবসর। কখনো এতখানি বিরতি দাওনি, যে তোমার কথা ভুলে যাবো। ফের, তোমার কথা মনে পড়বে। তারপর, মন স্বেচ্ছায় তোমার কাছে আসতে চাইবে। দিয়েছো সে অবসর?
- আসল কথা এ নয়। আসল কথা অন্য কেউ। কে?
- এ কথার অর্থ কি?  আমি তোমার প্রতি আকর্ষণ বোধ করিনা, অন্য কারো প্রতি বোধ করি?
- হয়তো তাই। আমি জানিনা।
- এই বলছো, আসল কথা কি তা তুমি জানো। এই বলছো, তুমি জানোনা। কোনটা ধরবো। তোমার কোন কথা ধরবো বলো?
- তুমি কি কথার উত্তর দিতেই এখানে এসেছো?
- না। আমি আসিনি। আনীত হয়েছি। কি জন্য, তা যিনি আনিয়েছেন তিনি জানেন।
- উঃ!
- কি হলো?
- না, কিছু না। তুমি সুখে থাকো।
- এ শুধু বলার ছিলো? বেশ। তবে যাই?
- না, যেয়োনা।
- যাবোনা তো করবো কি? তোমার চোখের জল মোছাবো বসে বসে? সে আমার সাধ্য নেই। সে অধিকারও বিধিবৎ আমার নয়। নয়?
- উঃ!
- কি?
- একদিন তুমি বুঝবে! বুঝবে যে ওরা কেউ নয়, তোমার ওই সুন্দরীরা, যাদের কথা তুমি বলো। তোমাকে সবচেয়ে বেশি উপরে যদি কেউ তুলে রেখেছিলো, তবে সে এই মধ্যবয়সিনী লোলচর্মা --
- থাক থাক।  তুমি জানো আমি সেসব গ্রাহ্য করিনা। তুমি জানো বয়স বা ত্বকের ঔজ্জ্বল্য দিয়ে আমি তোমায় দেখিনি। হ্যাঁ, কমবয়েসীর প্রতি টান থাকে, স্বাভাবিক। শুধু টানটান পিছল চর্ম নয়, অধিক সুখগম্য দেহ নয়, অল্পবয়সীদের মনেও যৌবন থাকে। তার আকর্ষণ থাকেই। কিন্তু প্রত্যেক বয়েসেরই সৌন্দর্য আছে। তোমারও নিজস্ব সুন্দরতা আছে। অনেক অনেকবার বলেছি, তবু তোমার মাথা স্বচ্ছ হয় না --
- তাহলে কেন আমার প্রতি তুমি প্রণয় বোধ করো না?
- আমি কারো প্রতিই প্রণয় বোধ করিনা দেবী! আমি শুধু নিজের প্রতি অনন্ত প্রীতি বোধ করি। বাকি যাকে যখন ভালো লাগে, সেটা নিজের ভালো লাগবে বলে তাদেরকে ভালো লাগে।
- তেমন ভালো আমাকে লাগেনা কেন?
- কারণ, ওইযে বললাম, তেমন অবসরই তুমি দাওনা। বিচ্ছেদ বোধ করতেই দাওনি। বিচ্ছিন্ন না হলে ফিরে মিলন হবে কিকরে?
- মিলন হবে? হবে, আমাদের?
- হচ্ছে তো নিয়তই। মিলিত হই তো। কিন্তু সে মিলন কিকরে হবে, যা বিচ্ছেদরসে সিঞ্চিত?
- এসব বলে আমায় ভোলাও। ওই ওদের তো ভোলাতে পারবেনা!
- কেউ কাউকে ভোলায়না দেবী। প্রত্যেকে নিজেকে ভোলায়। ওরাও ভোলায়। নহুলী যৌবন চোখে মদ্য মাখিয়ে রাখে, বিশ্বচরাচর সুধাবর্ষণ করে। তাতে মাতাল হয়ে থাকে। দেহে কীট থাকে, কামকীট। নহুলী যৌবনরসে কীট অনেক বেশী প্রাণবন্ত থাকে। সে কীটের মায়ায় তাদের মস্তক আচ্ছন্ন থাকে, তারা নিজেকে ভোলায়। তুমি ভোলাও নিজেকে, আমার প্রতি প্রণয়ে। আসলে, এই প্রণয় তোমারই মনঃসঞ্জাত, আত্মসুখের কারণেই।
- আমার প্রণয় সত্য। নিজের সুখের জন্য আমি তোমায় কামনা করিনি। তুমি তা নিজেও জানো। আর কেউ তোমার প্রতি এত উন্মাদ হয়? এত উঁচুতে রাখে তোমাকে? তবু, তবু কার? কার জন্য তুমি আমায় ঠেলছো?
- সে তো তোমার জানার প্রয়োজন নেই। তোমার সে  অধিকার নেই।
- হ্যাঁ হ্যাঁ জানি। ওই ধৃতার জন্য, না? ধৃতা তোমার বেশী পছন্দ নাকি সুধন্যা? কার জন্য, বলো?
- বারবার এক কথা বলে বিরক্ত কোরোনা। ওদের কারো জন্য নয়। তোমার জন্য। তোমার জন্যই আমি তোমার প্রতি বিরক্ত, বুঝলে?
- কেন, কেন আমি তোমার প্রিয়া নই? আমি কি তোমায় সব দিইনি?
- জোর করে প্রণয় পাওয়া যায়না দেবী!
- আমি জোর করেছি?
- করোনি? হ্যাঁ, রাজশক্তি ব্যবহার করোনি তুমি। কিন্তু বারবার, যখন তখন, যেখানে সেখানে তোমার নিষাদী দাসীকে পাঠাওনি? আমি হয়তো কোনো কাজে ব্যস্ত তখন, হয়তো সে মুহূর্তে অমনোযোগী হলে আমার প্রাণসংশয়, তবু তোমার নিষাদী দাসীকে দিয়ে তুমি আমায় আক্রমণ করেছো।
- আমি আক্রমণ করেছি? আমার সব তুমি। যখন ওপরে থাকো, জিজ্ঞেস করোনা, তুমি আমার কে? শোনোনি, আমার উত্তর? আমার কান্না কি মিথ্যে? আমার সুখ কি মিথ্যে? আমার সুখকান্না কি মিথ্যে? আমি তোমায় কি দিইনি?
- আমি এর কিছুই চাইনি।
- কিন্তু নিয়েছো।
- হ্যাঁ নিয়েছি। সে তোমারই  সন্তুষ্টিবিধানের জন্য। নিজের জন্য নয়। নিজের জন্য কিছু প্রয়োজন ছিলোনা আমার। এখনও নেই। আর, আমি দিইনি?
- কি দিয়েছো? প্রণয় দিয়েছো তুমি?
- আমি দিইনি প্রণয়, না? তাহলে ডাকো কেন আমাকে? কেন বারবার বিরক্ত করো?
- আমি বিরক্তিকর?
- উঁহু, মূল প্রশ্ন থেকে সরে যেয়োনা। আমি প্রণয় দিইনি তো আমায় ডাকো কেন?
- আমি যে তোমাকে ছাড়া থাকতে পারিনা।
- কেন? কে আমি তোমার? পতি নই, পুত্র নই, আমাতে তোমার কি?
- তুমি জানোনা কে তুমি?
- উল্টে প্রশ্ন কোরোনা। উত্তর দাও। কে আমি তোমার?
- জানিনা, আমি কিচ্ছু জানিনা।
- আমি প্রণয় দিইনি তোমাকে, বেশ, মেনে নিচ্ছি। আমি বলেওছিলাম প্রথমে, যে প্রণয় নেই আমার হৃদয়ে। আমি তা দিতে পারবোনা। কিন্তু আমি দিয়েছি। কি দিয়েছি তোমাকে আমি? জানো?
- কি?
- নিজেকে। নিজেকে দিয়েছি আমি। তোমার এমন নিবেদন, তোমার এ সর্বস্ব লুটিয়ে দেওয়া সমর্পণ, এর বিপরীতে আমি নিজেকে দিয়েছি। তুমি আমাকে কণামাত্র পেলে ধন্য হও। আমি নিজেকে নিঃশেষে দিয়েছি। প্রণয় আমার নেই। প্রণয় দিতে পারিনা আমি। বিকল্পে, এই দিয়েছি।
- তাহলে অন্য রমণীদের কথা যে শুনি?
- মানে? পৃথিবীর অন্য সকল রমনী মারা গেছে নাকি? তারা আছে, তাই তাদের কথা শোনো।
- তুমি যদি নিঃশেষে আমার কাছে নিজেকে দিয়ে থাকো, তাহলে অন্যদের কথা তোমার মনে স্থান পায় কিকরে?
- উঃ তুমি এত নির্বোধ! আমি তো তোমাকে চাইনা। প্রণয় বোধ করিনা। আমার মস্তকে প্রণয়বিষয়ক কোনো গ্রন্থি তো বাঁধা নেই। আমি তোমাকে নিঃশেষে কামনা করে তোমার কাছে নিজেকে দিইনি। তুমি ধন্য হবে বলে, তুমি চাও বলে আমি তোমার কাছে নিজেকে দিয়েছি। তুমি চাও বলে, তুমি উন্মাদিনী বলে। আমার তোমাতে কোনো প্রয়োজন নেই। ছিলোওনা কোনোদিন।
- কেন তোমার প্রয়োজন কে মেটায়, বলো? কার জন্য? কার জন্য? কার জন্য তুমি এমন করছো? ধৃতা? সুধন্যা? নাকি বংশদণ্ডের মতো ওই মুকুলিকা? বলো?
- তুমি মুকুলিকাকে নিয়ে কিছু বোলোনা। যা বলার আমাকে বলো।
- কেন? তোমার তাতে লাগছে কেন? মুকুলিকা কি তোমার রাজ্ঞী?
- না। হ্যাঁ, হতেও পারে। ধরো, হ্যাঁ। তো? তাতে তোমার কি? তুমি এ প্রশ্ন করতেই পারোনা। তোমার অধিকারই নেই।
- কেন অধিকার নেই? কিসের অধিকার? আমার চেয়ে ওই মুকুলিকার অধিকার বেশি?
- তুমি এ প্রশ্ন করতে পারো না।
- কেন করবোনা? আমার তোমার প্রতি অধিকার নেই?
- না। প্রথমেই বলে দিয়েছিলাম। নেই। মনে নেই?
- আমার প্রণয়ের কোনো দাম নেই?
- ওঃ আবার সেই একই কথা। প্রণয় নিয়ে কথা হচ্ছেনা। কথা হচ্ছে অধিকার নিয়ে।
- আমার প্রণয়ই আমার অধিকার।
- তাহলে সে প্রণয়ও আমি আর নিচ্ছিনা। তোমার অধিকারের সঙ্গে তোমার প্রণয়েরও এখানেই এখনই মূলোচ্ছেদ হোক।
- না যেয়োনা, দয়া করো, যেয়োনা।
-- শোনো, প্রণয় নিয়ে এতো কথা বোলোনা তুমি। অধিকার নিয়ে বোলোনা। প্রণয় নিয়ে কথা বলারঅধিকার তোমার নেই। আমার প্রতি অধিকার তো দূরের কথা।
-- কেন নেই আমার অধিকার? আমার অধিকার নেই তো কার আছে? ওই মুকুলিকার? ওই... ওই --
-- থাক, থাক, কারো নাম করতে হবেনা। সর্বদা পাশ কথায় চলে যেয়োনা। তোমার অধিকার নেই বলেছি। অন্য কারোর আছে সে অধিকার, এমন বলিনি।
-- না, তুমি বলো। তোমাকে বলতেই হবে। কেন আমার অধিকার নেই?
-- বলবো? হুঁ? বলবো? সহ্য করতে পারবে তো?
-- হ্যাঁ হ্যাঁ জানি তুমি কি বলবে। উঃ সেই একই কথা -
-- বাঃ মহাদেবী, বাঃ। তুমি বারবার একই কথা ঘুরে ফিরে বললে, তাই দিয়ে বারবার গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে আমার মস্তকটি ছিবড়ে করে দিলে দোষ নেই, আমি ন্যায্য কথা বারবার বললেই 'কেন বলছো'? সত্যি, রাজপরিবারের অধিকার সব বিষয়েই বেশি, নয়, দেবী?
-- তুমিও তো রাজবংশীয়! তুমি কাকে কথা শোনাচ্ছো?
-- আবার সেই পাশ কথায় চলে যাচ্ছো দেবী।
-- তুমি এই দেবী দেবী করা বন্ধ করো! আমি কি তোমার কাছে দেবী? আমার অসহ্য লাগছে। সেই সব সময়ে তো অন্য কিছু বলো-
-- স্বাভাবিক! এটা তো সেই অন্য সময় নয়। এটা এই সময়। এই ক্ষণের যে কথা, সেটাই তো এখন বলবো। কিন্তু তুমি আবার পাশ কথায় চলে যাচ্ছো!
-- উঃ!...
-- শোনো, আমি আমার ন্যায্য কথা বারবার বলবোই। তাতে অসুবিধা থাকলে বলো, আর কিচ্ছু থাকবেনা!
-- না, না, দয়া করো, যেয়োনা।
-- উঃ এই দয়া টয়া বোলোনা। তুমি কি বলছিলে? আমি রাজবংশীয়? না। এখানে কোনো রাজবংশ নেই, তুমি জানো। আমি বার্ষ্ণেয়। বৃষ্ণিবংশীয়। সাত্বত অন্ধক বৃষ্ণি ভোজ আদি যে বংশের যে ব্যক্তি যোগ্যতম, সে শাসনব্যবস্থার শীর্ষে থাকে, রাজবংশ বলে কিছু নেই মথুরায়, তুমি আমার জন্মের অনেক আগে থেকেই তা জানো, দেবী পদ্মাবতী। আমার বংশের কেউও সেই তথাকথিত রাজপদ গ্রহণ করতে পারে। আমিও পারি। যোগ্যতম হয়ে উঠলে। কিন্তু আমার তাতে অসুবিধা, আমার সেরূপ অভিরুচি নয়, তাও জানো। আমাকে রাজবংশীয় বলে আবার পাশ কথায় চলে যাবার দরকার নেই, দেবী!
-- উঃ!
-- প্রণয়? প্রণয়ের কথা তুমি বলো কিকরে? এতই বিভল অবস্থা তোমার, যখন তখন আমার পেছনে ধাওয়া করে তোমার দূত, কোনদিন কি বিপদে পড়বো ঠিক নেই, কোনদিন মহারাজ কিম্বা তাঁর সুপুত্রটি আমার মস্তকটি দেহ থেকে বিচ্যুত করেন তার ঠিক নেই, তুমি সেসব ভাববেনা। তোমার যখন চাই তখন চাই! তাতে প্রেমাস্পদের প্রাণসংশয় হয় তো হোক! তাতে তার মান যায় তো যাক! তুমি তোমার সুখ পেলেই হলো -
-- আমি নিজের সুখের জন্য তোমায় ব্যবহার করি? আমার এই সব কিছু মিথ্যা?
-- আবার পাশ কথায় যাচ্ছো। আমি বলছি তুমি নিজের উন্মাদ অবস্থা সামলাতে না পেরে আমায় তাড়া করো। তাতে আমার কি বিপদ হতে পারে, তা বুঝতে চেষ্টা করো না।
-- এখন তো আর অত বেশি করি না। আমি তো বুঝছি, বলো?
-- অত বেশি? অত বেশি? তুমি কি উন্মাদ? হ্যাঁ? উন্মাদ তুমি? নাকি আমার প্রাণ চাও? কি চাও কি তুমি?
-- আমি তোমার ক্ষতি চাই?
-- উঃ! আমি চলে যাবো! আমি চলে যাবো এই দেশ থেকে দূরে। যথাসাধ্য দূরে! উঃ!  কি পাপ করেছিলাম! কি ভুল করেছিলাম!
-- আমি তোমার ক্ষতি চাইনা, আমি তোমায় ছাড়া আর কিছু চাইনা, চাইনা -
-- হ্যাঁ ওসব আমি খুব জানি। আমি আসলে তোমার দাস। দায়ে বাঁধা পড়ে আছি। তিনদিন। মাত্র তিনদিন আমার খবর না পেলে তুমি অস্থির হয়ে যাও, তোমার দাসী মথুরা নগরীর সর্বত্র আমার সন্ধানে ফেরে। সরোবরে স্নান কিম্বা শৌণ্ডিকালয়ে পান করতে আমার অবসর নেই। যদিবা মৃগয়ায় থাকি, অরণ্যে আমার পশ্চাদ্ধাবন করে তোমার নিষাদী দাসী। এত তার তাড়া, এত নিশ্চিন্তে সে যে কোনো জায়গায় চলে যায়, যে আমাকে ভয় পেতে হয়। পাছে কেউ জানতে পারে। তোমার তো কিছু হবেনা। প্রাণটি যাবে আমার!
-- আমি আর কখনো করবোনা!
-- চুপ করো! স্তব্ধ হও! বহুবার এ'কথা শুনেছি আমি। দয়া করো, আমাকে নিষ্কৃতি দাও। তোমার পুত্রের অন্য কোন সখাকে বেছে নাও। অথবা, রাজসভা থেকে কাউকে। আমাকে ভুলে যাও। আমাকে আর ডেকোনো, ডেকোনা, আমি আর পারছিনা --
-- আমি তোমাকে ছাড়া কাউকে জানিনা। আমার আর কাউকে প্রয়োজন নেই। তুমি এমন কোরোনা। আমি সুখ চাইনা। আমি তোমাকে চেয়েছি শুধু --

নাসারন্ধ্র বিস্ফারিত অক্রুরের। চক্ষু তীব্র। মাথার চুল মুঠো করে কয়েকবার ধরতে হয়েছিলো বলে অবিন্যস্ত। বস্ত্রও অসংবৃত। পায়ের কাছে পড়ে আছেন মহারাণী পদ্মাবতী। পৃথুলা শরীর। অক্রুরের দুই পা ধরে রেখেছেন তিনি। ক্রন্দনের ধাক্কায় তাঁর শরীরে কম্পন। চোখের জলে অক্রুরের পা ভিজে যাচ্ছে।
অক্রুর প্রমাদ গুণলেন। তিনি জানেন, এই কান্না আর কিছুক্ষণ চললে তিনি দূর্বল হয়ে পড়বেন৷ তারপর স্বীকার করে নেবেন মহারাণীর প্রণয়। তারপর সব আবার আগের মতো। উঃ কেন যে এই ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন। দুঃখিনী নারী ভেবেছিলেন, পীড়িতা সঙ্গীহীনা অসহায় নারী ভেবেছিলেন, যন্ত্রণাকাতর নারী ভেবেছিলেন। সেসব দূঃখ, পীড়া, অসহায়তা, যন্ত্রণাকে নিজের ঘরে নিমন্ত্রণ দিয়ে আনলেন অক্রুর, ওঃ! এমন ভুলও মানুষ করে? এখন, একটু এদিক ওদিক হলে হয় প্রাণসংশয়, নয় মানসংশয়। দেশান্তরী হওয়া ব্যতীত সম্ভবতঃ অন্য উপায় নেই।

- ওঠো।
...
- ওঠো। আমার অসুবিধা হচ্ছে।
পা ছেড়ে দিলেন পদ্মাবতী। ঈষৎ সংবৃতা হলেন। কেঁদে যাচ্ছেন এখনো। মুখচোখ ফুলে আছে, লাল হয়ে আছে। এক্ষুনি, কয়েকমুহূর্তের মধ্যেই ওই মুখে হাসি ফোটাতে পারেন অক্রুর। কিশোরী মেয়ের মতো খিলখিলিয়ে হেসে উঠবেন রাণী, সদ্যবিবাহিতা তরুণীর মতো প্রেমনম্রা হয়ে উঠবেন। অকূলে ভেসে যাওয়ার মতো হয়ে উঠবে চোখ দুটি। এই রোদনময়ী মধ্যবয়সিনী হয়ে উঠবেন সদ্যযুবতী নারী ঐন্দ্রজালিক স্পর্শে। সেই ইন্দ্রজাল নিজের মধ্যে অনুভব করে গর্ব বোধ হয় অক্রুরের।
 
প্রণয়ের কথায় শুধু পুরুষ নারীকে ভোলায়না, নারীও নিজেকে ভোলায়। নারী পুরুষকেও ভোলায়। পুরুষও নিজেকে ভোলায়। ভোলানোই প্রণয়, তা ছাড়া যা কিছু তা হলো শরীর। শরীর দিয়ে ভোলানো সহজ, নিজেকে। অপরকে।
শরীর এবং ভোলানো, একত্রে অথবা আলাদাভাবে, প্রণয় নামক বিশ্বব্যাপী রটনাটিতে এতদ্ব্যতিরিক্ত কিছু নেই।

2 comments:

  1. অর্ঘ্য দত্ত31 May 2020 at 04:36

    শেষ লাইনটার জন্যই এতকিছু... ��
    একটু বেশিই ভাল লাগলো।

    ReplyDelete
  2. লেখাটি সুখপাঠ্য হলেও শেষে এসে লেখক যে মত প্রকাশ করলেন, তার সাথে সহমত হওয়া গেল না। শুধুই শরীর ও ভোলানো, এ ছাড়া প্রণয় আর কিছুই নয়, এ মত লেখকের। পাঠিকা মানছে না।
    লেখককে বলাই বাহুল্য, যে তাঁর কাহিনী যে সময়ে দাঁড়িয়ে, সেই সময়ের থেকে আর দুই আড়াই তিন দশক পেরোলে ওই ভূমিতেই আসবেন এক অলোকসামান্য জুটি। রাধা ও কৃষ্ণ। আজও সেই জুটিকে আমরা প্রণয়ের উচ্চতম সীমা বলে জানি। আজও তাদের নিয়ে কাব্য হয়, গাথা হয়, গান হয় গল্প হয়। পৃথিবীর এত এত কাব্য গান বেশিরভাগই প্রণয়ের। প্রণয় যদি এক অলীক ব্যাপারই হতো, এ সম্ভব হতো?

    আর একটি কথা। লেখাটি পড়ে অন্যদের কি হচ্ছে জানিনা, এ পাঠিকার হৃদয় সম্পূর্ণভাবে পদ্মাবতীকেই ভালোবেসে জড়িয়ে ধরছে। এবং অক্রুরকে আসলেই ক্রুর ও নিষ্ঠুর এক পুরুষ মনে করে বিরক্তি ও ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখছে। চরিত্রদু'টির প্রতি পোয়েটিক জাস্টিস হলো কি? মানছি একটি নির্দিষ্ট পর্বে সবদিক ছোঁওয়া সম্ভব নয়, তবু দাবী রাখলাম, কখনো পদ্মাবতীকে আরো ঋজু এবং অক্রুরকে আর একটু মানবিক আঁকা যায় যদি, তাহলে যেন চরিত্রদুটির প্রতিও সুবিচার হয়। বিবেচনা করি, পদ্মাও এত অসহায় নয়, অক্রুরও এত নিষ্ঠুর নয়। আর, প্রণয়ও তো এক যাত্রা। সে যাত্রাপথে অক্রুরও কখনো কাঁদুক, পদ্মাও কখনো তাকে বুকে আগলাক, এ দৃশ্য দেখার জন্য অপেক্ষা রইলো।

    ReplyDelete