প্রশান্ত
—‘ছেলে
হয়েছে।’
সারা রাত অপেক্ষার পর ভোরের দিকে নার্সের মুখ থেকে এইটুকুই জানতে পেরেছিল
প্রশান্ত। বুকের ভিতর একরাশ আনন্দ ঝলকে উঠেছিল স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু তখন আর কে
জানত তার জন্য কী প্রচণ্ড একটা ধাক্কা অপেক্ষা করে আছে!
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে মা আর বেবিকে বেডে দেওয়া হলে চাপা উত্তেজনা নিয়ে সে
কেবিনে ঢুকল। ঢুকেই সদ্যোজাত শিশুটিকে দেখার জন্য সুরভীর বেডের পাশে রাখা কটে দিয়ে
হামলে পড়ল। এবং আঁতকে উঠল। দশ মাস ধরে পুষে রাখা আনন্দ-উচ্ছ্বাস-দুশ্চিন্তা সব
নিমেষে মিলিয়ে গিয়ে তার মন ভরে গেল এক ভয়াবহ আতঙ্কে।
বিস্ফারিত চোখে সুরভীর দিকে তাকায় সে। ও-ও ব্যাপারটা জানে, দেখেছে।
প্রশান্তর সঙ্গে চোখাচুখি হতেই যেন এক তীব্র যন্ত্রণায় মুখ ফিরিয়ে নিল। প্রশান্ত
দেখল ওর দু’ চোখ বেয়ে নেমে আসছে জলের ধারা।
মাথা-টাথা সব গুলিয়ে যাচ্ছে। প্রশান্ত আবার বাচ্চাটার দিকে তাকাল। মনে এক অবোধ
আশা, যদি এবার অন্য কিছু দেখে! যদি প্রথমবারের দেখাটা চোখের ভুল হয়!
একটা হালকা গোলাপি রঙের মানবশিশু। নরম অসহায় একটা মানুষ কুঁকড়ে মুকড়ে শুয়ে
ঘুমোচ্ছে। পুতুলের মতন ছোট্ট-ছোট্ট হাত-পা, নাক-মুখ, বোজা চোখ— সবই ঠিক আছে।
শুধু...
শুধু মাথায় শিং-এর মতন ওই দুটো কী!
পরের
দিন। একটু আগে অফিস থেকে বেরিয়ে নার্সিংহোমে গিয়ে ডক্টর চ্যাটার্জির সঙ্গে দেখা
করল প্রশান্ত। গতকালই কথা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু ডেলিভারিটা করানোর পরেই
ডাক্তারবাবু বেরিয়ে যান।
—‘এসব কী ডক্টর চ্যাটার্জি? এর’ম তো কখনও শুনিনি!’
—‘আমিও শুনিনি। আমার চব্বিশ বছরের কেরিয়ারে তো নয়ই, এমনকি কোনও মেডিক্যাল
রেফারেন্সও নেই।’ এইটুকু বলে খানিকটা অন্যমনষ্ক হয়ে নিজের মনেই যেন বললেন ডক্টর
চ্যাটার্জী— ‘যদিও কাটেনিয়াস হর্নসের দু’-একটা কেস শোনা যায় কিন্তু সে সম্পূর্ণ
অন্য জিনিস।’ আবার প্রশান্তর দিকে তাকিয়ে বলতে থাকেন তিনি— ‘আই হ্যাভ কনসালটেড উইথ
মাই সিনিয়র। হি টু ইজ ডাম্বস্ট্রাক। আপনি বোধহয় নাম শুনেছেন। ডক্টর মৈত্র। আজ
আসছেন আপনার ছেলেকে দেখতে।’
—‘আচ্ছা, একটা কথা বলে দি, আই ডোন্ট ওয়ান্ট এনি ন্যুউসেন্স অ্যারাউন্ড হিম।
প্লিজ যদি...’
—‘ও ব্যাপারে আপনি না বললেও চলত। ভাববেন না।’
—‘বাট ওয়াট ইস দিস? অ্যান্ড ওয়াট’স দ্যা ওয়ে আউট?’
—‘আই অ্যাম সরি মিস্টার বিশ্বাস, বাট দেয়ার ইসন’ট এনি ওয়ে আউট।’
—‘মানে অপারেশান-টপারেশান করে যদি...’
ডক্টর চ্যাটার্জী হেসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন— ‘আমি আজ সকালে ওর মাথার একটা
স্ক্যান করিয়েছি। রেজাল্ট ইস কোয়াইট ইন্টারেস্টিং। ওই হর্ন-লাইক জিনিসগুলোর উপর
থেকে টু-থার্ড পোরশান কনসিস্টস অফ বোন। আর নীচের বাকি ওয়ান-থার্ড কী জানেন?’
—‘কী?’
—‘সোজা কথায় বলতে গেলে ব্রেন। এক্সটেন্ডেড পোরশান অফ হিজ ফ্রন্টাল লোব।’
প্রশান্ত চশমা খুলে দু’ হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেলল।
ডক্টর চ্যাটার্জী বললেন— ‘ইয়েস, সুতরাং বুঝতেই পারছেন অপারেশান করার
চিন্তাটা কতখানি অবাস্তব।’
প্রশান্ত কিছু বলল না। একই ভাবে বসে রইল।
ডক্টর চ্যাটার্জি সামনে ঝুঁকে পড়ে সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন— ‘আমি
আপনাদের ক্রাইসিসটা বুঝতে পারছি। ফার্স্ট ইস্যু... সেখানেই এইরকম একটা কমপ্লিকেশন,
কিন্তু সত্যি করে ভেবে দেখুন তো এতটা ভেঙে পড়ার মতো কি কিছু হয়েছে? লেট মি
অ্যাসিওর ইউ মিস্টার বিশ্বাস দ্যাট ইওর সন’স হেলথ ইজ পারফেক্টলি অলরাইট। আমরা
সবকিছু টেস্ট করে দেখেছি, হি ইজ এ হেলদি বয়।’
প্রশান্ত নিরুত্তর।
—‘তাছাড়া ভেবে দেখুন’, ডক্টর চ্যাটার্জী বলে চললেন— ‘আমাদের দেশে কতরকমের
প্রতিবন্ধী বাচ্চা জন্মায়। সেখানে আপনার ছেলেকে একটা নরমাল বার্থ বলা যায়। ও বড়
হয়ে আর পাঁচটা বাচ্চার মতোই হবে।’
প্রশান্ত এবার আস্তে আস্তে সোজা হয়ে বসে, চশমা পড়তে পড়তে বলে— ‘না ডক্টর
চ্যাটার্জি, ওর জীবন আর পাঁচটা বাচ্চার মতন মোটেই হবে না। হতে পারে না। আচ্ছা... ওর
ব্রেনের এরকম স্ট্রাকচারের জন্য ওর ইনটেলিজেন্সে কোনো প্রভাব পড়বে কি?’
ডক্টর চ্যাটার্জি একটু ভেবে বললেন— ‘সেইরকম কিছু জোর দিয়ে বলা যায় না কিন্তু
ভাবতে অসুবিধা কোথায় মিস্টার বিশ্বাস যে ইওর সন উইল বি দ্যা নেক্সট আইনস্টাইন? বা
চাইল্ড প্রডিজি জাতীয় কিছু?’
প্রশান্ত ডক্টর চ্যাটার্জির মুখের দিকে চেয়ে একটু হাসল। ম্লান হাসি।
সুশান্ত
সুশান্ত কিন্তু মারাত্মক কিছু ইনটেলিজেন্ট
হয়নি। আর পাঁচটা বাচ্চার মতনই তার মেধা। তবে স্কুলে পড়াকালীন ক্লাসে বরাবর প্রথম
দশের মধ্যে থাকত। কিন্তু সে এমন আর কী।
শিং-এর ব্যাপারে
ছোটোবেলায় মাত্র একবারই প্রশ্ন করেছিল সে। সুরভী তাকে বুঝিয়েছিল, এটা এক ধরনের
অসুখ, বড় হলে আপনা-আপনি সেরে যাবে।
এরপর থেকে দেখা গেল সুশান্ত
খেলতে খেলতে ঘুরে ফিরে মাঝেমাঝেই আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে নিজের মাথার দিকে চেয়ে
থাকে। শিংগুলো ছুঁয়ে দেখে। বোধহয় বুঝতে চাইত আদৌ কমছে কিনা। এইটুকু ছাড়া এ নিয়ে
তাকে নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতে দেখা যায়নি।
কিন্তু প্রশান্ত যেমনটা
ভেবেছিল ঠিক তা-ই হল। প্রথম ধাক্কাটা এল স্কুল থেকেই।
পুজোর ঠিক আগে আগে,
সুশান্ত তখন ক্লাস ফাইভে। একদিন স্কুল থেকে ওকে আনতে গিয়ে সুরভী লক্ষ করল ও কীরকম
গুম মেরে রয়েছে। রোজ বাড়ি আসতে আসতে স্কুলে সারাদিন কী কী করেছে, কে কে মিসের কাছে
বকুনি খেল— সেসবের ফিরিস্ত দেয়, রাস্তায় এটা-সেটা কিনে দেওয়ার জন্য বায়না করে। আজ
সেইসব কিছুই নেই। সারাটা পথ একটাও বাড়তি কথা নেই ছেলের মুখে। তখনই সুরভীর মনটা কু
ডেকেছিল।
বেশি অপেক্ষা করতে হল
না। বাড়িতে এসে ইউনিফর্ম ছাড়ার সময় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল— ‘আমি কাল থেকে আর স্কুলে
যাব না।’
—‘কেন? কী হল হঠাৎ!’
—‘ওরা আমাকে আজ সারাদিন
মহিষাসুর বলে খেপিয়েছে... শিংদুটোর জন্যে, ওরা বলেছে আর-এক মাস বাদেই মা দুর্গা এসে
আমাকে বধ করবে। আমার আর ভালোলাগছে না স্কুলে।’
সুরভী কী উত্তর দেবে
বুঝতে পারল না।
সন্ধেবেলা প্রশান্ত অফিস
থেকে ফিরে সব শুনে কিছুক্ষণ কপাল টিপে বসে রইল। এটা তো হবারই ছিল। বেশ দেরি করেই হল
বলতে হবে। তারপর হঠাৎ যেন গা ঝাড়া দিয়ে উঠে সুরভীকে নিয়ে ছেলের ঘরে গিয়ে ঢুকল।
সুশান্ত সেদিন পড়তে
বসেনি। চুপটি করে খাটের একধারে বসে ছিল। চোখদুটো তখনও লাল, ফুলো-ফুলো।
সুরভী দাঁড়িয়ে রইল।
প্রশান্ত ছেলের মুখোমুখি বসে ছেলের দু’কাঁধে দুটো হাত রেখে একটু হেসে প্রথমে
জিগ্যেস করল— ‘কী? মন খারাপ?’
সুশান্ত উত্তর দিল না,
শুধু চোখ দু’টো আবার জল ভরে গেল।
—‘শোন, কাঁদিস না।’
প্রশান্ত খুব সহজভাবে, আস্তে আস্তে বলতে শুরু করল— ‘আজ তোকে কতগুলো কথা বলব। খুব
মন দিয়ে শুনবি আর চেষ্টা করবি সারাজীবন মনে রাখার। সব কথা হয়তো আজই বুঝতে পারবি
না, কিন্তু আমরা তো আছি তোর সাথে, যখনই প্রয়োজন পড়বে আবার সব বুঝিয়ে দেব, সব মনে
করিয়ে দেব।’
—‘মনে রাখিস তুই কারও
থেকে আলাদা নোস। বাকি পাঁচজন যেমন, তুইও ঠিক
সেইরকমই। শুধু তোর কপালটা একটু খারাপ। কেন বল তো? প্রতিটা মানুষের মধ্যে একটা না
একটা অসঙ্গতি আছে, সবাই কোনও না কোনওভাবে অ্যাবসার্ড। তোর দুর্ভাগ্য তোর অসঙ্গতিটা
বাইরে থেকে বোঝা যায়। কিন্তু তলিয়ে ভাবতে গেলে সেটা এমন কিছু বড় ব্যাপার নয়। যেমন
তোর আর তোর মায়ের নাকটা দেখ কেমন সুন্দর। অথচ আমার নাকটা দেখ কী অস্বাভাবিক লম্বা
আর মোটা। এটা আমার শারীরিক অসঙ্গতি আর তোদের চোখে এটা অস্বাভাবিক, যেহেতু তোদের এই
সমস্যা নেই। যারা খুব রোগা বা খুব মোটা হয় একজন সাধারণ চেহারার মানুষের
কাছে তারাও কিন্তু অ্যাবসার্ড।’
—‘এই পৃথিবীর প্রায় সব
মানুষের মধ্যে একটা ভয়ানক দুষ্টুমি আছে। সেটা হল মানুষের দুর্বল জায়গায় ক্রমাগত
আঘাত করে খুঁচিয়ে ঘা করে দেওয়া। আজ জীবনে প্রথমবার তুই তার পরিচয় পেলি এবং আমার
কথা লিখে নে, সারাজীবন ধরে তোকে এই জাতীয় দুষ্টুমি সহ্য করতে হবে। সোজাসুজি তোকে
বলছি আজ, যে জন্য তুই খুব কান্নাকাটি করলি আজ সেইরকম আঘাত ক্রমাগত চারিদিক থেকে
আসতেই থাকবে আজীবন। আর সেই যে বললাম তুই একা নোস, প্রত্যেকটা মানুষের দিকেই এই
পৃথিবী সারাক্ষণ নানারকম ইটপাঁটকেল ছুঁড়তে থাকে, যেহেতু সবারই কোনও না কোনও দুর্বল
জায়গা আছে। কিন্তু তা বলে কি মানুষের জীবন থেমে যাবে? না। আচ্ছা বল তো, তোর মুখেই
তো শুনেছি তোর ক্লাসের সেই মোটা ছেলেটার কথা, যাকে তোরা সবাই মিলে ‘হাতি’ বলে
খেপাস— তুইও বলিস, আমি জানি— সে কি তোদের ভয়ে স্কুল ছেড়ে পালিয়ে গেছে? লোকের কথায়
খুব কষ্ট হয়, অপমানিত লাগে, বুঝি, কিন্তু মনে রাখিস মানুষের জিভের এত জোর নেই যে
তার ভয়ে অন্য একজন মানুষের জীবন থমকে যাবে। লোকে যা বলছে, বিশেষ করে যে কথায় তোর
কোনও উপকার হবে না সেটা এক কান দিয়ে শুনে আর-এক কান দিয়ে বার করে দেওয়াটাই হল বেস্ট
পলিসি।’
—‘আর তুই যদি সত্যিই চাস
মানুষের মুখ বন্ধ করতে তাহলে তোর যেটা কাজ সেটা মুখ বুজে কোনও দিকে না তাকিয়ে করে
যেতে হবে। শুধু তা-ই নয় চেষ্টা করতে হবে সেটায় শ্রেষ্ঠ হবার, যাতে লোকে যখনই তোর
ব্যাপারে কথা বলে তখন যেন অন্যান্য কোনও টপিক তাদের মাথাতেই না আসে। যেমন এখন তোর
একমাত্র কাজ পড়াশুনো, সেটা দারুণভাবে করার চেষ্টা কর। আবার শুধু পড়াশুনোয় ভালো হলেই
চলবে না, তোকে সত্যিকারের ভালো হতে হবে। কীরকম ভালো? এই ধর আজ তোকে যারা খেপিয়েছে
তুই যদি কোনওদিন তাদের একটাও খারাপ কথা না বলিস, উলটে তারা অ্যাবসেন্ট করলে
তাদেরকে নিজের কপি বাড়ি নিয়ে যেতে দিস বা তাদের ক্লাসওয়ার্কে হেল্প করিস। এইরকম
ভালো হবার কথা বলছি আমি। এতে কী হবে? না ওরা তোর ওপর নির্ভর করতে শুরু করবে। আর
যখনই ওরা দেখবে তোকে ছাড়া ওদের চলছে না, তখনই তোকে আঘাত করার কথা ওরা আর ভাবতে
পারবে না। মানুষ এরকমই।’
কিছুক্ষণ থেমে ছেলের
দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে প্রশান্ত বলল— ‘যা যা বললাম বুঝলি তো?’
সুশান্ত মাথা নাড়ল।
—‘মনে রাখবি তো? মেনে
চলবি তো এগুলো সব?’
—‘চলব।’ এতক্ষণে কথা বলল
সুশান্ত।
—‘ওকে চল। আজ মায়ের
রান্নার ছুটি। রেস্তোরাঁয় ডিনারটা সারা যাক। তোর ফেভারিট বিরিয়ানি...’
এবার সুশান্তর মুখে হাসি
ফুটল।
কিন্তু রেস্তোরাঁয় গিয়ে
আবার সেই একই বিপত্তি।
ওদের পাশের টেবিলে বসা
ফ্যামিলির বাচ্চা মেয়ে দুটো তো বটেই, বাপ-মাও হাঁ করে সুশান্তর দিকে চেয়ে রইল।
মাঝেমাঝে নিজেদের মধ্যে ফিসফিসানিও চলতে থাকল, কিন্তু বিস্ফারিত চোখগুলো কিছুতেই
আর ওর ওপর থেকে সরতে চায় না।
সুশান্তর অস্বস্তি
হচ্ছিল। সে কাঁদো-কাঁদো মুখ করে বারবার উলটোদিকে বসা বাবার মুখের দিকে তাকাতে
লাগল।
ব্যাপারটা মোটেই প্রশান্তর
চোখ এড়ায়নি। ছেলের কানে কানে সে বলল— ‘কিচ্ছু না, শুধু সোজা ওদের মুখের দিকে
তাকিয়ে থাক...’
সুশান্ত ঠিক সেটাই করল।
এবার কিন্তু লোকগুলো চোখ সরাতে বাধ্য হল। তারপর নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
সুশান্ত আবার বাবার দিকে
তাকাল। এবার মুখে এক গাল হাসি।
অবশেষে ছেলের চোখে একঝলক
আত্মবিশ্বাস দেখে প্রশান্ত মনে মনে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।
সেদিন বাবার কথাগুলো ম্যাজিকের মতো
কাজ করেছিল। বাড়ি ফিরে এসে রাতে যখন সুশান্ত শুতে যাচ্ছিল মনখারাপ-টারাপ তখন জাস্ট
ভ্যানিস!
ক্রমে যখন সে দেখল,
সত্যিই তাকে ক্রমাগত মানুষের সেই বিশ্রী অভ্যাসটার মুখোমুখি হতে হচ্ছে, তখন বাবার
কথাগুলো প্রাণপণে আঁকড়ে ধরা ছাড়া আর কোনও পথ দেখল না।
স্কুলে জায়গা পালটে সে
লাস্ট বেঞ্চের কোনার দিকে বসতে শুরু করল। পুরনো বন্ধুদের গ্রুপটার থেকে সে এভাবে
নিজেকে সরিয়ে নিল। টিফিনে যখন তাকে নানাভাবে প্যাঁক দেওয়া চলত সে মুখ টিপে জানলার
দিকে চেয়ে বাবার বলা কথাগুলো মনে মনে আওড়াত। অনেকে তাকে বিড়বিড় করতে শুনল— ‘ভালো
হতে হবে, সত্যিকারের ভালো।’ তাই সে কোনওদিন কোনও মিসকে কমপ্লেন করেনি। উপরন্তু তার
উৎপীড়নকারীদের মধ্যেই যখন কেউ হোমওয়ার্ক করে আনতে ভুলে গেছে সে নিজে আগ বাড়িয়ে
নিজের খাতাখানা তার দিকে বাড়িয়ে ধরেছে। ঠিক বাবা যেমনটা বলেছিল। কিন্তু একটা
ব্যাপার বাবার বলা কথাগুলোর সঙ্গে মেলেনি। তারা ওর উপকার নিয়েছে বটে, কিন্তু পরে হেনস্থা
করতেও ছাড়েনি।
পড়াশুনোয় সত্যি খুব মন
দিয়ে ফেলেছিল। তার ফল মিলল হাতেনাতে। প্রতিবার অ্যানুয়াল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর
পর দেখা যেতে লাগল যে প্রথম তিনে ‘শিংওয়ালা ছেলে’টা রয়েছে। বছর কয়েক পর দেখা গেল
এই ‘শিংওয়ালা ছেলে’টাই মাধ্যমিকে স্কুল থেকে টপ করেছে। আর তারপর এইচ এসেও।
পাড়ায় বন্ধু-টন্ধু
পাতানো বা তাদের সঙ্গে খেলার প্রশ্নই ওঠে না। স্কুলে যাতায়াতটুকু ছাড়া সে বাড়ির
বাইরে বিশেষ পা রাখত না। প্রশান্ত প্রতি বছর বইমেলা ঘুরে প্রচুর বই কিনে এনে দিত
ওকে। তখন আস্তে আস্তে সিডি-ডিভিডির রমরমা শুরু হয়েছে। প্রশান্ত প্রথমে একটা দামি
ডিভিডি প্লেয়ার কিনল। তারপর প্রচুর ডিভিডি-টিভিডি কিনে জমজমাট একটা কালেকশান বানাল।
এইসব নিয়ে আর মা-বাবার সঙ্গে আড্ডা দিয়ে দিব্যি সময় কেটে যেত ওর।
সুশান্তর পরম সৌভাগ্য
জীবনের প্রথম ধাক্কাটা খাওয়ার পরই সে একটা ঢাল পেয়ে গেছিল। ঢালটা তার মনটাকে
পৃথিবীর দূষিত ধোঁয়া-ধুলোর থেকে আড়াল করেছিল বটে, কিন্তু ক্রমশ বাড়তে বাড়তে সেই
ঢালটাই হয়ে দাঁড়াল একটা দেয়াল, যার একদিকে গোটা পৃথিবী, আর-একদিকে সুশান্ত।
সুরভীকে ব্যাপারটা
অনেকদিন ধরেই কুড়েকুড়ে খাচ্ছিল। একদিন কথা প্রসঙ্গে ওর আশঙ্কার কথা প্রশান্তকে না
বলে পারল না— ‘ওর একটাও বন্ধু নেই, দেখেছ! এর’মভাবে ও বাঁচবে কী করে?’
সমস্যাটা যে প্রশান্তকে
একেবারেই ভাবায়নি তা নয়। বন্ধুবান্ধব, মেলামেশা— এগুলো না থাকলে কি একজন মানুষের
মানসিক বিকাশ সম্পূর্ণ হয়? একজন বিচক্ষণ মানুষ হিসাবে এটা সে ভালোই বুঝত যে
বন্ধুরা ভালো জিনিস যেমন শেখাবে, তেমনি আরও এমন অনেক জিনিস শেখাবে যেগুলো জানা
প্রত্যেকের পক্ষে অত্যন্ত জরুরি, অথচ সেসব বাঙালি পরিবারের বাপ-মায়েরা ছেলেমেয়েদের
শেখাতে পারে না।
কিন্তু সুরভীর
দুশ্চিন্তা উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল বলে সে হালকা চালে বলল— ‘কে বলল ওর বন্ধু নেই? ওর
টিউটররা আছে, আমরা আছি।’
—‘আমরা কি সারা জীবন ওর
সঙ্গে থাকব? আর টিউটররাই বা ক’দিন?’
—‘আরে বন্ধুবান্ধব করার
সময় তো পালিয়ে যাচ্ছে না। আশা করি কিছু মানুষ এখনও আছে যারা মানুষের বাইরের
চেহারার চেয়ে ভিতরের রূপটাকে বেশি প্রায়োরিটি দেয়। আমি বিশ্বাস করি এমন এক-দু’জন
ঠিক আমাদের বাবাইকে খুঁজে নেবে।’
সে যাইহোক, জ্বর আর
অসহ্য মাথার যন্ত্রণা নিয়ে পরীক্ষা দেওয়ার ফলে জয়েন্টে সুশান্তর র্যাঙ্ক আশানুরূপ
হল না। তবে ডাক্তারিটা হাত থেকে একেবারেই বেরিয়ে গেলেও কলকাতার নামি এক বেসরকারি
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে চান্স পেতে বিশেষ অসুবিধা হল না।
প্রথম দিন সে কলেজে গেল
সেই অদৃশ্য দেয়ালের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে।
প্রথম দিনের প্রথম
ক্লাস। কিন্তু আশেপাশের মানুষগুলোর চোখের চাহনিতে নতুনত্ব কোথায়? কয়েকজন কথা শুরুই
করল ‘এক্সকিউজ মি, আর দে অরিজিনাল? কী করে হল?’— এই ভাবে। কয়েকজন
ইনিয়ে-বিনিয়ে নাম, স্কুলের নাম জিগ্যেস করার পর প্রশ্নটা করল। বেশিরভাগ টিচারই
ইন্ট্রো নেওয়ার মাঝে ব্যাপারটা খুঁচিয়ে তুলল। টিফিনে হালকা র্যাগিং হল। কিন্তু
সুশান্তর দিকে তাকিয়ে সিনিয়ররা এতটাই ভেবড়ে গেল যে হালকা একটু র্যাগিং করেই
নিষ্কৃতি দিল। অর্থাৎ কিনা প্রথম দিনেও তাকে দাগিয়ে দেওয়া হল, তুমি আলাদা, কিম্ভুত।
যেভাবে চলার কথা
সেইভাবেই সব চলছিল। সবই গা-সওয়া, সে প্রথম দিন থেকেই মন দিয়ে পড়াশুনা শুরু করল।
ব্যাপারটা ঘটল সপ্তাহখানেকের
মাথায়। সে লাইব্রেরিতে দাঁড়িয়ে একটা বইয়ের জন্য রিকুইজিশন লিখছিল। হঠাৎ মনে হল কেউ
তার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। তা সে আর নতুন কী! কিন্তু প্রতিবর্ত ক্রিয়ার বশে
চোখ তুলে তাকাতেই সে শুনল ‘মাই গড’ আর তারপরেই, ধপাস!
মেয়েটা আইটির কেকা
চক্রবর্তী। পরে গোটা কলেজ যাকে ন্যাকা চক্রবর্তী বলে চিনবে। ন্যাকা ঘটনাটা পরে
বহুবার এইভাবে বর্ণনা করেছিল— ‘আই ওয়াজ সো স্কেয়ার্ড অ্যাট দ্যাট মোমেন্ট দ্যাট
ওয়েন দ্যাট ক্রিচার স্টেয়ার্ড অ্যাট মি, আই থট ইট ইস গোয়িং টু বাইট...’
সুতরাং যে জিনিসটা হয়তো
মাস তিনেক পর শুরু হত সেটা শুরু হয়ে গেল এক সপ্তাহ পরেই। ততদিনে ক্লাসটা কয়েকটা
গ্রুপে ভাগ হয়ে গেছে। মানুষ দল বেঁধে খেলে, নাচে, গায় এবং অন্য মানুষকে উৎপীড়ন
করে। ‘কীরে বগনা, ন্যাকাকে গোঁতাতে গেছিলি?’ বা ‘কোন শিংটা দিয়ে গোঁতালি যে পুরো
সেন্সলেস করে ছাড়লি?’ জাতীয় প্রশ্ন কান পাতলেই শোনা যেতে লাগল।
সে অম্লানবদনে সব সহ্য
করতে লাগল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই দলগুলো যত পুরনো হতে লাগল ততই তার উপর অত্যাচার
বাড়তে লাগল। একবার এরকমই একটা দল তাকে ধরে পেটাল ‘জাস্ট ফর ফান’। অবশ্যি গুরুতর একটা কারণ ছিল না যে তা নয়, সে গাঁজার কল্কেতে টান দিতে চায়নি।
তবুও সে মুখ বুজে নিজের কাজ করে চলল। বাড়িতে একবারের জন্যও এসব বলা তো দূরে থাক, ‘কলেজ
যাব না’ বা ‘কলেজ যেতে ভালোলাগে না’ জাতীয় কথা মুখেই আনল না। সেমেস্টারের সময় তার
খাতা থেকে রিলে করে টোকা চলতে লাগল। প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার সময় সে একা হাতে এক্সপেরিমেন্ট
করে, তার গ্রুপের সবাই তার নেওয়া রিডিং খাতায় টুকে পাশ করে। এরাই পরীক্ষা দিয়ে
বেরিয়ে দেয়ালে তার মাথা ঠুকে দিতে দিতে বলে— ‘এট্টু গুতিয়ে দেখা!’ তারপর যখন শোনে
সে বিড়বিড় করছে ‘ভালো হতে হবে, ভালো হতে হবে, সত্যিকারের ভালো’, তখন তার
বিন্দুবিসর্গ কিচ্ছু না বুঝে হ্যাহ্যা করে হাসতে হাসতে তাকে আরও পেটাতে থাকে।
এইভাবেই তিন-তিনটে বছর
কাটিয়ে ফেলল সে।
ক্যাম্পাসিং শুরু হল।
প্রথম দুটো কোম্পানিতে অ্যাপটি, টেকনিক্যালে অন্য অনেকের থেকে ভালো করে এইচআর
রাউন্ডে তার নাম কেটে দেওয়া হল সহজবোধ্য কারণেই।
মানুষের প্রতি বিশ্বাস
তখনও সুশান্তর উবে যায়নি। কারণ এতদিন সে নিজের পরিশ্রমের মূল্যটুকু অন্তত পেয়ে
এসেছে। এই প্রথম সেই জায়গাটাতেও সে দাগা খেল এবং আবার ভেঙে পড়ল।
আর এবারেও তার
একমেবাদ্বিতীয়ম ত্রাতাকে এগিয়ে আসতে হল। প্রশান্ত ব্যাপারটা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে
বলল— ‘তাতে কী এসে গেল? তুই কী ভাবছিস, তুই চাকরি পেলেই আমি তোকে করতে দেব? তাও
সফটওয়্যারে? আমি চাই এরপর তুই এম. টেক কমপ্লিট করে পিএইচডি করিস। তোর মতো ভালো
ছেলেদের সেইটাই এইম হওয়া উচিত।’
যদিও তিনবারের বার
সুশান্তর কপাল খুলল, যাকে বলে থার্ড টাইম লাকি।
তৃতীয় কোম্পানিটাও ছিল
আইটি ফার্ম। এরা মার্কেটলিডার হবার দৌড়ে নেই বটে, তবে একেবারে ফেলনাও নয়। তা এহেন
একটা কোম্পানির ক্যাম্পাসিংয়ের দিন সুশান্তর এইচআর রাউন্ড হয়ে যাবার পর কলকাতা
রিজিয়নের বাঙালি এইচআর সুশান্তদের ট্রেনিং অ্যান্ড প্লেসমেন্ট অফিসারকে ডেকে
পাঠাল।
—‘মিস্টার বাগচি, ওয়াটস
রং উইথ দিস গাই ? আই মিন দ্য গাই উইথ হর্নস...’
—‘অল আই নো ইস এটা
জন্মগত। বাট হি ইস অ্যা ভেরি গুড বয়। সিরিয়াস, শার্প...’
—‘সেটা আপনি না বললেও
আমি বুঝতে পেরেছি। হি হ্যাজ টপড দ্যা অ্যাপটি। হিজ
টেকনিক্যাল নলেজ ইস এক্সসেলেন্ট। কমিনিকেসন স্কিল ইস গুড। শুধু পারসোনালিটির
কয়েকটা দিকে একটু খামতি আছে, উইচ ইস কোয়াইট কমন অ্যামং ফ্রেশার্স।’
—‘সো? উইল ইউ...’
—‘সেটাই তো বুঝতে পারছি
না! এইরকম একটা ক্যান্ডিডেটকে কোথায় প্লেস করব বলতে পারেন? প্রথমত ওর প্রেজেন্সটাই
ফ্লোরে অনেকের কাছে ডিস্টার্বিং হবে, এতে কনসেনট্রেশনের প্রবলেম হতে পারে,
সেক্ষেত্রে পারফরম্যান্সে তার প্রভাব পড়বে। দ্বিতীয়ত, আর সব থেকে ইমপরট্যান্ট,
আপনি তো জানেনইনি যে বেশির ভাগ প্রোজেক্টেই ক্লায়েন্ট ভিজিট লেগে থাকে। তা এইরকম
একটা এমপ্লয়িকে ক্লায়েন্টের সামনে প্রজেন্ট করা... ইউ নো ওয়াট আই মিন...’
—‘দেখুন মিস্টার মুখার্জি,
একেই মার্কেটের অবস্থা খুব খারাপ। রিশেসন যা হচ্ছে তা তো আর বলার নয়। তারপর যদি
ভালো স্টুডেন্টগুলো প্লেসমেন্ট না পায়, তাহলে ম্যানেজমেন্টের সামনে আমার মুখটা
থাকে কোথায় বলুন তো? প্লিজ একটু কনসিডার করুন। আমি বলি কী, ওকে নিয়ে রাখুন, দেবেন
না হয় একটা অগামার্কা ডোমেন, একটা আলুভাতে-দুধভাত প্রোজেক্ট, যেখানে ক্লায়েন্টের
তত উৎপাত নেই। আর কিছু না হলে বেঞ্চ তো আছেই। এরকম একটা ক্যানডিডেটকে ছাড়বেন কেন?
প্লিজ মিস্টার মুখার্জি!’
অতএব সেবার পিছনের দরজা
দিয়ে গলে গেল সুশান্ত। লিস্টে সবার শেষে হলেও তার নাম উঠল।
এবং সুশান্ত বাবা-মাকে
বুঝিয়ে-সুঝিয়ে জয়েনও করল। বলল— ‘করব তো এম. টেক। পিএইচডি-টিএইচডি সব করব। আগে
বছরখানেক চাকরি করে নি, বাবা? প্লিজ! তোমার ওপর আর কত চাপ দেব বলো? আর তাছাড়া
এক্সপেরিয়েন্সটা পরে কাজে লাগবে।’
প্রশান্তর মুখে এসে যাচ্ছিল
ইলেকট্রনিক্স নিয়ে এগোতে চাইলে আইটির এক্সপেরিয়েন্স কোন ছাতার কাজে লাগবে? কিন্তু
ছেলের এত উৎসাহ দেখে আর কিছু বলল না। রাজি হতেই হল।
ট্রেনিং শুরু হয়ে গেল।
প্রথম প্রথম সেই অবাক চোখে তাকানো, সেইসব গতে বাঁধা প্রশ্ন চলতে থাকল। যদিও
ব্যাপারটা কলেজের মতো অসভ্যতার পর্যায়ে গড়াল না।
সুশান্ত হাঁফ ছেড়ে
বাঁচল। অবশেষে এমন একটা জায়গা যেখানে লোকে নিজের কাজ নিয়ে মেতে থাকে, অন্যের পিছনে
লাগার মতো সময় নেই কারও। অবশেষে একটু শান্তি।
ট্রেনিংয়ের পর কলকাতাতেই
একটা ছোট প্রজেক্টে দেওয়া হল তাকে। ছোট, কারণ টিম মেম্বার মোটে ছ’জন। তাকে নিয়ে
সাত। চারটে ছেলে, দুটো মেয়ে আর ম্যানেজার।
ম্যানেজার যখন টিমের
সবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিচ্ছিল জীবনে এই প্রথমবার সুশান্ত অবাক হয়ে দেখল তাদের কারও
চোখে সেই প্রশ্নটা নেই, কারও চোখ তার চোখদুটো ছেড়ে মাথার ওপর উঠে এসে কুঁচকে গেল
না। কারও হাসি দেখেই মনে হল না জোর করে চোয়াল দুটো টেনে রেখেছে। সামান্য এই
ব্যাপারখানা তার কী যে ভালোলাগল! প্রথম দিনেই টিমটাকে ভালোবেসে ফেলল সে।
মানুষের সঙ্গ ভালোলাগা— এটাও
তার জীবনে এক নতুন অনুভূতি। মা-বাবা ছাড়া এমন কিছু মানুষের সঙ্গে আলাপ হল যাদের সঙ্গে
কথা বলতে ভালোলাগে। এখানে সবাই খুব হাসি-খুশি, যেন মনে হয় নিজের জীবনটা নিয়ে সবাই
বড় সুখী। কাজের ফাঁকে ফাঁকে প্রচুর গল্প হয়। হাসি-ঠাট্টা লেগেই থাকে। লেগপুলিংও চলে কিন্তু কাউকে কোনওভাবে আঘাত না করে। এরা যেন এক অন্য জগতের
মানুষজন!
খুব মন দিয়ে কাজ করতে
লাগল সে। অফিসে যাবার জন্য ছেলের সে কী উৎসাহ ! বাড়িতে ফিরেও অফিসের গল্প যেন
ফুরোতে চায় না।
ছেলেকে খোশ মেজাজে দেখে
প্রশান্ত-সুরভীর মনটাও ভালো হয়ে যায়। সেইসঙ্গে ওর মধ্যের ছটফটানিটাও চোখ এড়ায় না।
শনি-রবি দু-দুটো দিন ছুটি! বড্ড বেশি যেন। বাড়িতে মন টেকে না।
তারই মধ্যে সারাদিন
এসএমএস আসতে থাকে। ফোনটা হাতে নিলেই চকচক করে ওঠে ছেলের চোখ।
সুরভী এক রোববারের দুপুরে খাওয়াদাওয়ার
পর জিগ্যেস করল— ‘আচ্ছা বাবাই, নন্দিনী কে রে? অফিসের কেউ?’
সুশান্ত সরলভাবে বলল— ‘হ্যাঁ
তো। অফিসে আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু।’
—‘ও। তুই যখন সকালে
স্নানে গেছলি, ওর একটা এসএমএস ফুটেছিল তোর ফোনে।’
—‘হ্যাঁ জানি, দেখেছি।
সারাদিনই তো ওর সঙ্গে টুকটাক কথা হয় এসএমএসে। বড় ভালো মেয়েটা। ছোটবেলায় বাবা মারা
যাওয়ার পর ওর মা অনেক কষ্ট করে ওকে আর ওর দাদাকে পড়িয়েছে। ওর দাদাও ইঞ্জিনিয়ার।
এখন তো মা-ও আর নেই। দাদা-বউদিকে পাগলের মতো ভালোবাসে ও আর ভাইপো গুবলু তো ওর
প্রাণ।’
—‘এতকিছু ও তোকে বলেছে?’
—‘হ্যাঁ। বললাম না ও-ই
আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। তাছাড়া আমিও ওকে আমার... আমার সব...’
ঠিক সেই সময়ই সুশান্তর
ফোনটা বেজে ওঠে। এসএমএস। ও ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সুরভী কিছুক্ষণ ছেলের উজ্জ্বল হয়ে
যাওয়া মুখের দিকে চেয়ে থাকেন।
স্ত্রীর কাছে সব শুনেটুনে
প্রশান্ত ঘাড় দুলিয়ে এমন একটা হাসি দিল যার একটাই মানে হতে পারে— ‘বলেছিলাম কিনা?’
নন্দিনী
নন্দিনী ওয়াশরুম থেকে ফেরার সময়
দেখল শোভ্না কাজ না করে কী একটা এক্সেল খুলে বসে আছে। অর্থাৎ গুলতানি মারছে। তাই
ওর পিছনে লাগার জন্য পিছন থেকে ওর মাথায় আলতো করে একটা চাঁটি লাগাল।
চাঁটি খেয়ে চমকে ফিরে
তাকিয়ে নন্দিনীকে দেখে বলল— ‘তুঝে হি ঢুন্ড রাহি থি। ইধার দেখ, সুশান্ত্ কা
বার্থডে কব হ্যায়।’
নন্দিনী বলল— ‘কী
ব্যাপার বল তো! হঠাৎ সুশান্তর বার্থডে নিয়ে পড়লি কেন? সে তো জানি, সিক্সথ জুন।’
—‘ইয়েস! তু কুছ সমঝি?’
—‘ক্যায়া সমঝু?’
—‘বাতাতি হুঁ।
উসকে পহলে অউর এক চিজ পাতা করনা হোগা। উসকা টাইম অফ বার্থ।’
—‘সেটাও আমি জানি।
সিক্সথ ইলেভেন ইন মরনিং।’
কথাটা শেষ হতে না হতেই
শোভ্নার চোখদুটো গোলগোল হয়ে গেল। ও বলে উঠল— ‘মাই গড! সিক্স সিক্স সিক্স! জ্যায়সা
কে ম্যায় সোচ রাহি থি!’
—‘ক্যায়া মতলব? ক্যায়া
সিক্স সিক্স সিক্স?’
—‘দেখ নন্দিনী, তুঝে শায়দ
মালুম নেহি, লেকিন অ্যাকরডিং টু টেস্টামেন, সিক্স সিক্সটি সিক্স ইস দ্য নাম্বার অফ
বিস্ট!’
—‘তো?’
—‘আই থিংক সুশান্ত ইস
দ্য সাটান।’
—‘ওয়াট রাবিস আর ইউ টকিং
শোভনা!’
—‘ইটস নট রাবিস। তুজে শায়দ
ইয়াদ নেহি লেকিন সিক্সথ জুন দো হাজার ছে মে পেপার ভ্যাগেয়রা পর বহত সারে আর্টিকল
আয়া থা ইস বারে মে। ম্যায়নে তব সে পড়না শুরু কিয়া থা। বাইবেলমে লিখা হ্যায় কে যব
সাটান দুনিয়া মে আয়েগা উসকে কহি না কহি পর সিক্স সিক্সটি সিক্স মিলেগা। দেয়ার ইস
অ্যা ফিল্ম কলড দ্য ওমেন। উসমে ভি দিখায়া গেয়া হ্যায়।’
—‘ইয়ে সিক্স সিক্সটি
সিক্স ক্যায়সে হুয়া। সিক্সথ জুন তক ঠিক হ্যায়, লেকিন উসকে বাদ টাইম হ্যায় সিক্স
ইলেভেন।’
—‘লেকিন সিক্স তো হ্যায়
না। একদম সেম টু সেম নেহি ভি হো সাকতা হ্যায় শায়দ। অউর দুসরি বাত ইয়ে টাইম উসনে
তুঝে বাতায়া। উয়ো ঝুট ভি বোল সাকতা হ্যায়।’
—‘তুই পাগল হয়ে গেছিস।
দিমাগ খারাব হো গেয়া হ্যায় তেরা।’
—‘ঠিক হ্যায়। মুঝে
বিসওয়াস মাত কর। তু খুদ হি ইন্টারনেট পে পড়লে। বহত সারা ইনফো হ্যায় ইস বারে মে।
বহত সারে লোগ ইসপে বিলিভ করতে হ্যায়। ইয়ে ফালতু কি চিজ নেহি হ্যায়। অউর তু খুদ হি
সোচ, অন হিজ লুকস আই হ্যাভ নাথিং টু সে, লেকিন আজকাল কোই ইতনা ভি ইনোসেন্ট হোতা
হ্যায় ক্যায়া? ডোন্ট ইউ থিংক হি ফেকস অল দ্য টাইম? কিতনে বাংগালি হ্যায় জো পূজা কে
টাইম ঘরসে নেহি নিকালতে হ্যায়? ইয়ে তো খুদ উসিনে হি হামে বাতায়া থা, হ্যায় কে
নেহি? কভি সোচা হ্যায় কিউ?’
—‘কিউকে উয়ো সাটান হ্যায়
অউর সাটান গডকে সামনে নেহি আতা। ইয়ে হি না? শুন ম্যায় ইস বারে মে তুজসে বহেস করনা
নেহি চাহতি। তুজে জো সোচনা হ্যায় সোচ। মুজে বাস ইতনা মালুম হ্যায় কে উয়ো এক আচ্ছা
লাড়কা হ্যায়।’
কথাটা বলে বলে নন্দিনী
চলে আসছিল। শোভ্না ওর হাত টেনে ধরে ওকে বলল— ‘নান্দিনী শুন, মুঝে পাতা হ্যায় কে
তুম লোগ ইমোশানালি ক্লোজ হো, লেকিন ম্যায় তেরা ভালা চাহতি হু। প্লিজ সামহাল যা।
ইয়ে আচ্ছি বাত নেহি হ্যায়।’
নন্দিনী একঝটকায় ওর হাত
ছাড়িয়ে নিজের কিউবিকলে চলে এল।
ওর কিউবকলটা থেকে
সুশান্তকে দেখা যায়। বসতে বসতে নন্দিনীর চোখ গেল ওর দিকে। সেও ওর দিকে দেখছিল। দু’জনের
চোখাচুখি হতেই সুশান্ত প্রতিবারের মতো হাসল। নন্দিনীও হাসি ফিরিয়ে দিল বটে, কিন্তু
নিজের অজান্তেই অবাক হয়ে ওর দিকে চেয়ে রইল।
হঠাৎ ওইরকম চাহনি দেখে
সুশান্তও খানিকটা ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল। কপাল কুঁচকে ভুরু নাচিয়ে জিগ্যেস করল— ‘কী
ব্যাপার?’ নন্দিনী সঙ্গে সঙ্গে হেসে মাথা নেড়ে চোখ নামিয়ে নিল।
নন্দিনী ভেবেছিল শোভ্নার
প্রলাপগুলোকে মোটেই পাত্তা দেবে না। কিন্তু যেরকম জোরের সঙ্গে ও কথা বলছিল... আর
সত্যি বলতে কি সুশান্তর এই অতি ভালোমানুষী ভাবটা যে প্রথম প্রথম তারও অস্বাভাবিক
লাগেনি তেমন নয়। কিন্তু ওর সঙ্গে ভালোভাবে মেশার পর ব্যাপারটা ভুলে গেছিল... শোভ্নার
কথাগুলো মন থেকে তাড়ানো গেল না কিছুতেই।
সেদিন ওর হাতে সেইরকম
কোনও কাজ না থাকায় ও গুগল খুলে লিখল ট্রিপল সিক্স। সত্যি
প্রচুর কিছু রয়েছে এই বিষয়ে। শোভ্নার কথা ভুল নয়, ব্যাপারটা বাইবেল-স্বীকৃত। দ্য
ওমেন সিনেমাটার সিনোপসিসটাও পড়ে নিল সে। যা যা পড়ল তার কিছুটা বুঝল, বেশিরভাগটাই
বুঝল না। সবকিছু মিলিয়ে তার মনে একটা অদ্ভুত জগাখিচুড়ি গোছের ভাব হয়ে রইল।
এরপর সে সাটানের ছবি সার্চ
করল। যে ব্যাপারটা তার মনে সবথেকে বেশি দাগ কাটল সেটা হল প্রত্যেকটা ছবিতেই
সাটানের মাথায় শিং রয়েছে। আর-একটা ছবি দেখে তার গা-টা এমন মারাত্মকরকম গুলিয়ে উঠল
যে তখনকার মতো সে ক্ষান্ত হল। ছবিটায় শয়তান একটা বাচ্চার মুণ্ডু ছিঁড়ে খাচ্ছে।
সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে
খাওয়াদাওয়া সেরে নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে এই নিয়েই ভাবছিল নন্দিনী। এমন সময় সাইলেন্ট
করে রাখা ফোনটায় আলো জ্বলে উঠল। সে খুলে দেখল সুশান্তর এসএমএস— ‘হাই।’
বাড়ি ফিরতে নন্দিনীর
ন’টা বেজে যায়। সাড়ে দশটা অবধি গুবলুর সঙ্গে খেলা, তারপর ডিনার সেরে রাত সাড়ে
বারোটা-একটা অবধি সুশান্তর সঙ্গে সুখ-দুঃখের গল্প করে ঘুম। এতদিন এমন রুটিনেই
চলছিল সে। কিন্তু আজ কেন কে জানে নন্দিনীর ইচ্ছে হল না ওর সঙ্গে কথা বলতে। ওকে
কোনও রিপ্লাই না দিয়ে ফোনটা উলটো করে রেখে টিভি চালিয়ে বসল।
সাড়ে বারোটার সময় শুতে
যাবার সময় ফোনটা আবার হাতে নিয়ে দেখল তাতে দুটো এসএমএস রয়েছে। দুটোই সুশান্তর।
প্রথমটায় লেখা— ‘তুই বোধহয় আজ ঘুমিয়ে পড়েছিস না? ওকে গুড নাইট। কিন্তু আজ অফিসে
তোকে খুব ওয়ারিড লাগছিল। হোপ এভরিথিং ইস অলরাইট উইথ ইউ।’ পরেরটা মাত্র দশ মিনিট
আগের। ‘ওকে, গুডনাইট দেন।’
নন্দিনী এইবার না লিখে
পারল না— ‘সরি, গুবলুর অন্নপ্রাশনের ব্যাপারটা নিয়ে একটু বিজি ছিলাম। গুডনাইট।’
সুশান্ত
—‘কীরে, অন্ধকার ঘরে বসে কী
করছিস?’
—‘নাঃ, মা কিছু না... আসলে
মাথাটা একটু ধরেছে। ও তুমি ভেবো না। রাতে ঘুমোলেই ছেড়ে যাবে।’
—‘তোর অফিসে সব ঠিক আছে
তো?’
—‘হঠাৎ!’
—‘না আসলে আমি আর তোর
বাবা আলোচনা করছিলাম, তুই হঠাৎই খুব চুপচাপ হয়ে গেছিস। মানে প্রথম প্রথম যে
উৎসাহটা ছিল...’
—‘ওহো... না না সব ঠিক
আছে... আসলে প্রথম চাকরি তো, প্রথম প্রথম সবারই অমন হয়, তারপর আবার যে কে সেই... ভেবো
না।’
সুশান্ত বলল আর সুরভীও
শুনল। কিন্তু দু’পক্ষই জানে যে, সব ঠিক নেই। সুরভী আজকাল আর ছেলের মুখে সেই আলোটা
দেখতে পায় না। আর সুশান্তও ভিতরে ভিতরে নন্দিনীর এই আচমকা বদলে যাওয়াটা নিয়ে
জেরবার হয়ে যাচ্ছে। নন্দিনী তাকে কেমন এড়িয়ে চলছে। পাঁচটা এসএমএস করলে পাঁচ ঘণ্টা
পর হয়তো একটা সংক্ষিপ্ত উত্তর আসে। না হয় বোঝা গেল সারাদিন অফিস সামলে ভাইপোর
অন্নপ্রাশনের জোগাড়-যন্তরের ভার ঠেলে আর মেসেজ করার মতো এনার্জি থাকে না। কিন্তু
অফিসে? সেখানে এমন তোলা তোলা ব্যবহার শুরু করল কেন? মেপে হাসে, এমনভাবে কথা বলে যেন
ফরমালিটি করছে। ওর কি তবে আজকাল আর তাকে ভালোলাগছে না?
এমন পরিস্থিতি সুশান্তর
কাছে নতুন। একজন মানুষ তাকে অপমান করছে না, অত্যাচার করছে না, শুধু যেমন খোলামেলা
ব্যবহার করত তার বদলে তাকে একটু এড়িয়ে যাচ্ছে আর শুধুমাত্র এই সামান্য কারণে তার
বুকটা টনটন করে উঠছে— এও তার আছে এক আনকোরা অভিজ্ঞতা। শুধু একজনের আচমকা বদলে
যাওয়াটা আর-একজনকে এতখানি কষ্ট দিতে পারে!
সুশান্ত প্রাণপণে নিজেকে
বোঝায় আজ কারও সঙ্গে কথা বলতে ভালোলাগলে সারাজীবন যে লাগবে এমন কোনও মানে নেই। সে
নিজেও এসএমএস করা বন্ধ করে দেয়। আবার ফিরে যায় নিজের জগতে, দেয়ালের পিছনে। কিন্তু
সেখানেও আর সুখ নেই। সঙ্গের নেশা এমনই।
তবে তার যন্ত্রণার আংশিক
প্রশমন ঘটে মাস দুয়েক পরেই, যেদিন নন্দিনী এসে গুবলুর অন্নপ্রাশনের কার্ডটা তার
হাতে দেয়। সেদিন নন্দিনীকে খুব হাসিখুশি লাগছিল। অনেকদিন বাদে আগের মতো হেসে অনেক
কথা বলে সুশান্তর কিউবিকলে এসে।
সে নিমেষে তিন মাস ধরে
চলতে থাকা যন্ত্রণার কথা ভুলে যায়। তার মনে কেমন একটা মৃদু আশা জাগে, হয়তো এই
অনুষ্ঠানটা মিটে গেলেই নন্দিনী আবার আগের মতো হয়ে যাবে।
অন্নপ্রাশনের জন্য বিরাট হল ভাড়া
করেছিল নন্দিনীরা। সেদিন সেজেগুজে বাকি কলিগদের সঙ্গে
সুশান্তও সেখানে পৌঁছে গেল।
আর গিয়ে থেকেই সমানে
অস্বস্তি লাগতে লাগল। অনেকে তাকে দেখে আঁতকে সরে গেল, কেউ কেউ অবাক হয়ে চেয়ে রইল।
ফিসফিসানি শুরু হয়ে গেল। এইসবই তো তার গা-সওয়া। তবুও আজ কিছুতেই যেন এগুলো
অগ্রাহ্য করতে পারছিল না।
এসবের মধ্যেই একঝলক
টাটকা বাতাসের মতো এসে নন্দিনী ওর দাদা-বউদির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। ওঁদের ব্যবহার
সেই পুরনো দিনের নন্দিনীর মতোই আন্তরিক। বাচ্চাটাকে কোলে নেবার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল,
কিন্তু সে ওধার মারাল না। নিজেকে সংযত করল। কে জানে বাবা, গুবলু যদি ভয়-টয় পেয়ে
যায়...
খানিকক্ষণ অফিস কলিগরা
একটা জায়গায় জটলা করে আবার নিজের মধ্যে আড্ডায় মেতে উঠল। সে চেষ্টা করছিল আলোচনার
মধ্যে ঢুকতে। কিন্তু তাকে ঘিরে মানুষের কৌতুহল যেন আর থামে না। বারবার অন্যমনস্ক
হয়ে যাচ্ছিল। নন্দিনী কাছাকাছি থাকলেও না হয় ভুলে থাকা যেত। কিন্তু তাকেও তো দেখা
যাচ্ছে না।
হলটার এককোণ দিয়ে দেয়াল
থেকে একটু জায়গা ছেড়ে একটা বেদি মতো জায়গা করা হয়েছে। যার
ওপরে একটা ছোট্ট কটে গুবলু আর পাশে দাঁড়ানো আয়াটা। আর কেউ নেই আপাতত সেখানে। এটা
চোখে পড়ায় গুবলুকে একবারটির জন্য কোলে নেবার ইচ্ছেটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল।
তাকে বেদিতে উঠতে দেখে
আয়াটার চোখ দুটো গোলগোল হয়ে গেল। কিন্তু কিছু বলল না। সুশান্ত সোজা কট থেকে
গুবলুকে কোলে তুলে নিল।
নন্দিনীর এসএমএসে গুবলুর
অনেক বর্ণনা পড়েছে সে। আজ ওকে হাতে নিয়ে মনটা ফুর্তিতে নেচে উঠতে চাইল। গুবলুর
মুখটা ও নিজে মুখের কাছে ধরল। কী সুন্দর হাসে বাচ্চাটা। হাত বাড়িয়ে সুশান্তর
চশমাটা ধরতে চাইল। সুশান্ত মুখটা সরিয়ে নিতেই আবার খিলখিল হাসি... সুশান্তর মনে হল
পৃথিবীর সব চাইতে সুন্দর একটা অনুভূতির সঙ্গে ওর পরিচয় ঘটছে। সে কেমন যেন হারিয়ে
ফেলল নিজেকে। লোকজনকে যেমন দেখেছে সেইভাবে বাচ্চাটাকে হাতে দুলিয়ে দুলিয়ে হাঁটতে
শুরু করল। বাচ্চাটাও কী ভালো! বেশ বেড়াচ্ছে ওর কোলে চড়ে। আর ফিকফিক ফোকলা দাঁতের
হাসি লেগেই আছে। আয়াটা কোথায় যেন চলে গেছে। ভালোই হয়েছে একদিকে...
হাঁটতে হাঁটতে নিজের
অজান্তেই নেমে পড়ে সে বেদিটার পিছনে চলে এসেছিল।
সংবিৎ ফিরে পেল নন্দিনীর
গলার আওয়াজে।
—‘ও কী! ও কী!’ নন্দিনী
এমনভাবে চেঁচিয়ে উঠল যেন চমকে ওঠায় আর-একটু হলে হাত ফসকে পড়ে যেত গুবলু।
নন্দিনী ছুটে এসে ওর হাত
থেকে গুবলুকে কেড়ে নিতে নিতে বলে— ‘কী করছিস কী ওকে নিয়ে তুই!’
সুশান্ত তখনও কিছুই
বোঝেনি। নন্দিনীর এই আচরণ, গলায় এই উত্তেজনা মেশানো ভর্ৎসনা প্রথমটায় সে খেয়াল করল
না, ‘না মানে একটু’ গোছের কিছু একটা বলতে গিয়ে হতভম্ব হয়ে শুনল নন্দিনী কীসব যেন
বলে যাচ্ছে!
—‘রাক্ষস কোথাকার! মারবি
নাকি বাচ্চাটাকে! ভাগ্যিস সুমিতা ছুটে এসে আমাকে বলল, না হলে কী যে হত!’
নন্দিনী এত জোরে
চেঁচাচ্ছিল যে তখন অনেকে ওর গলা শুনে সেখানে ছুটে এসেছে। তার মধ্যে সুশান্তদের
ম্যানেজার অনিন্দ্যদাই প্রথমে জিগ্যেস করল— ‘কী হয়েছে নন্দিনী? এত চেঁচাচ্ছিস কেন?’
নন্দিনী অত্যন্ত অভদ্রের
মতো হাত নেড়ে অনিন্দ্যদাকে বলল— ‘ওকে জিগ্যেস করো তো ওদিকে কেন গেছিল গুবলুকে নিয়ে?’
পরের কথাটা আরও জোরে বলল— ‘কী করছিল ও ওকে নিয়ে?’
অনিন্দ্যদা একবার
সুশান্তর মুখের দিকে তাকাল। সুশান্ত তখন আর কিছু দেখছে না, কিছু শুনছে না, কিছু
ভাবছে না। শুধু অবাক হয়ে নন্দিনীর রুদ্রমূর্তির দিকে চেয়ে আছে।
অনিন্দ্যদা সব বুঝতে
পেরে বলল— ‘তাতে কী হয়েছে? তুই ওরকম করছিস কেন?’
—‘ওরকম করছি কেন? ওটা
একটা আস্ত রাক্ষস! একটা শয়তান!’
কথা দুটো সুশান্তর বুকে
এত জোরে ধাক্কা মারল যে মনে হল সে পড়ে যাবে। পা দুটো কেঁপে উঠল। তবুও মুখে একটা
শব্দ উচ্চারণ করতে পারল না। যেমন ভাবে নন্দিনীর দিকে চেয়েছিল সেইভাবেই চেয়ে রইল।
নন্দিনীর দাদা এগিয়ে এসে
বলল— ‘এসব কী যা-তা বলছিস তুই! পাগল হয়ে গেলি নাকি!’
—‘যা-তা কথা! আমি ঠিক
সময়ে না এলে বুঝতে... তোমরা তো আর জানো না। আর জানবেই বা কী করে? মুখ-চোখটা কেমন
করে দাঁড়িয়ে আছে দেখো... যেন কিচ্ছুটি বোঝে না! জিগ্যেস করো ওকে... পুজোআর্চার দিন
ঘরে বসে থাকে কেন? জিগ্যেস করো।’
—‘নন্দিনী তুই কিন্তু
বেশি বাড়াবাড়ি করছিস।’ অনিন্দ্যদা আবার বলল।
—‘তুমি শুনে রাখো
অনিন্দ্যদা, হয় তুমি এটাকে প্রোজেক্ট থেকে তাড়াও নইলে আমি কালই রেজিকনেশান দেব।
একটা হাফ জানোয়ারের সাথে কাজ করতে পারব না।’
প্রতিটা কথা কান দিয়ে
ঢুকে ওর সমস্ত শরীর-মন পুড়িয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ও বুঝতে পারছিল না
নন্দিনীর হঠাৎ হলটা কী! এটা কী নন্দিনী না অন্য কেউ?
হঠাৎ সে বুঝতে পারল সে
চলতে শুরু করেছে। তার মধ্যেও কানে এল শোভ্নার গলা— ‘নান্দিনী সহি বোল রেহি হ্যায়
অনিন্দ্যদা। ম্যায় আপলোগোকো সামঝাতি হুঁ।’
সুশান্ত যখন বাড়ি ঢুকল তখন রাত
সাড়ে দশটা বাজে। বাবা-মা সবে খেতে বসেছে।
দরজা খুলে সুরভী সবে
শুরু করতে যাচ্ছিল— ‘কীরে হয়ে গেল... কী ব্যাপার? কী হয়েছে?’ শেষের প্রশ্ন দুটো
ছেলের কালো ক্লান্ত মুখের ওপরে চোখ পড়তেই আপনা-আপনি বেরিয়ে এল।
সুশান্ত কোনও জবাব দিল
না। নিজের শরীরটাকে কোনওমতে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে ধপ করে খাটে বসে পড়ল।
সুরভী, প্রশান্ত দু’জনে
এঁটো হাতেই ওর ঘরে ছুটে গেল— ‘কী হয়েছে তোর? কীরে? বলবি তো?’
দু’জনে বারেবারে বলতে
লাগল।
ওদের উদ্বেগ, উৎকন্ঠা
কিছুই সুশান্তকে ছুঁল না। শুধু কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বলে উঠল—‘আমি
তো শয়তান। আমি একটা রাক্ষস।’
তারপর শুধু ওর চোখ দিয়ে
নিঃশব্দে জল গড়ায় আর রোবটের মতো একঘেয়ে কণ্ঠস্বরে বলে চলে— ‘আমি তো শয়তান। একটা
আস্ত রাক্ষস।’ এর বেশি আর কিছুই বলতে পারে না।
ওরা শুধু এইটুকু বুঝতে
পারে খুব গুরুতর কিছু একটা ঘটেছে। কিন্তু তখন ওসব দিকে মাথা ঘামানোর মতো মানসিকতা
ওদের নেই। ছেলেটাকে কীভাবে সামলাবে কিছুতেই মাথায় আসছে না দু’জনের।
সুরভী ওর জামাকাপড়
ছাড়িয়ে দেয়। প্রশান্ত তার নিজের ভঙ্গিতে সান্ত্বনা দিতে থাকে। কিন্তু আজ কিছুতেই
কিছু কাজ হয় না। এত বছর যে দেয়ালটা ওকে আড়াল করে রাখত সেটা যেন আজ ধসে গেছে। গাল-গলা
বারবার মুছিয়েও চোখের জল শুকোনো যায় না। থামে না সেই সুরহীন ঘড়ঘড়ানি— ‘আমি শয়তান।
আমি রাক্ষস।’
একটানা চার ঘণ্টার চেষ্টায়,
রাত আড়াইটে নাগাদ ক্লান্ত সুশান্তকে ঘুম পাড়ানো গেল। কিন্তু একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে
শুতে গেল প্রশান্ত আর সুরভী। কী হয়েছিল সেটা জানা অত্যন্ত জরুরি, কিন্তু আপাতত কাল
সকাল অবধি অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই করার নেই। অনিন্দ্য বলে ছেলেটাকে ফোন করা যেত...
কিন্তু রাত তো কম নয়।
তখন সবে আলো ফুটেছে।
পাশের ঘরে ভারী কিছু পড়ার শব্দে চমকে জেগে উঠল প্রশান্ত। বাকি রাতটা এপাশ-ওপাশ
করতে করতে কখন যেন একটু তন্দ্রামতন এসে গেছিল। খানিকক্ষণ হতভম্বের মতো চোখ বড়-বড়
করে শুয়ে থেকে লাফিয়ে উঠে পাশের ঘরে গিয়ে উঁকি মারে সে।
আর সঙ্গে সঙ্গে পা দুটো
টলে যায়। ডানহাতে নিজেই নিজের মুখটা চেপে ধরে, বাঁহাত নিজের অজান্তেই চুল ধরে
টানতে থাকে।
সুশান্তর ঘাড় মটকানো
দেহটা কিছুক্ষণ ধড়ফড় করে সবেমাত্র শান্ত হয়েছে কিন্তু সিলিং থেকে তখনও যেন
ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে চেয়ে আছে।
প্রশান্ত
বাড়িতে
কী করে যেন প্রচুর লোক এসে জুটেছে। কারা যেন সুশান্তর দেহটা নামিয়ে চাদর দিয়ে ঢেকে
দিয়েছে। এই চাদরটা দিয়েই কি মরণফাঁস বানিয়েছিল ও? প্রশান্ত একবার বলতে চাইল— ‘ওর
মুখটা ঢাকোনি কেন তোমরা? ঢেকে দাও!’
দৃশ্যটা দেখেই সুরভী সেন্সলেস হয়ে পড়েছিল। এখন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বডিটার ওপর
আছাড়ি-পিছাড়ি করে কাঁদছে। একদল মহিলা ওকে টেনে রাখতে চেষ্টা করছে, পারছে না।
দৃশ্য, শব্দ সবকিছুই ভীষণ ভীষণ অসহ্য লাগছিল প্রশান্তর। ইচ্ছে করছিল এই
মুহূর্তে একছুটে কোথাও পালিয়ে যেতে। গো-হারান হেরো মানুষেরা যেভাবে পালিয়ে বাঁচে।
কে একজন একটা ফোন এগিয়ে দিল তার দিকে— ‘এটা বাজছিল। অনিন্দ্যদা বলে কেউ...’
ফোনটা কানে দিতেই ওপাশ থেকে কে একজন বলে উঠল— ‘সুশান্ত? ভালো আছিস তো ভাই?’
—‘সুশান্ত মরে গেছে।’
—‘মানে? কী বলছেন কী আপনি! আপনি কে?’
প্রশান্ত এবার ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে— ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, যা বলছি ঠিক বলছি। সুশান্ত
গলায় দড়ি দিয়েছে। বুঝলে?’
—‘কিন্তু আপনি কে বলছেন? কাকু? হ্যালো? হ্যালো?’
মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে... প্রথম থেকেই... পুরো হিসেবটাই ছিল ভুলে ভরা কিন্তু ভুলগুলো ঠিক
কোথায় তা বুঝতে পারে না প্রশান্ত... কার ভুল? নিশ্চয়ই তার? আবার পরক্ষণেই মনে হয়
এসব ভেবে এখন লাভ?
কতক্ষণ যেন কেটে যায়। ছোট্ট ফ্ল্যাটটায় ভিড় বাড়ে আরও কিছুটা।
এমন সময় একটা ফরসা, লম্বামতন মেয়ে এসে দাঁড়ায়। ওর চোখদুটো ছলছল করেছে।
প্রশান্তর মুখটা চেনা চেনা মনে হয়। মেয়েটা বলে— ‘আঙ্কল, আমার নাম নন্দিনী।
সুশান্তর কলিগ। আপনাকে কয়েকটা কথা বলতে চাই। আন্টিকে বলতে পারলে ভালো হত... কিন্তু...’
প্রশান্ত হাঁ করে মেয়েটার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। মেয়েটা বলে যেতে থাকে— ‘কীভাবে
শুরু করব জানি না... কিন্তু ব্যাপারটা যে এতদূর গড়াবে, এত বড় একটা ঘটনা ঘটে যাবে
আমি বুঝতেই পারিনি... আপনাদের কাছে সব স্বীকার না করলে আমি জীবনেও শান্তি পাব
না... এই সবকিছুর জন্য আমিই দায়ী... হঠাৎ অমনভাবে মেজাজ হারানো আমার... আপনারা যা
খুশি শাস্তি দিতে পারেন আমাকে...’
তারপর আরও অনেক কিছু বলে গেল মেয়েটা। প্রশান্ত শুনল কী শুনল না, বুঝল কি বুঝল না সেসব ওর
মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই।
নন্দিনীর কথা বলা শেষ হতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নীচু করল প্রশান্ত।
তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল—‘এসো আমার সঙ্গে।’
সুশান্তর ঘরে ঢুকতেই মনে একটা আতঙ্ক জেগে উঠল। কিন্তু তা সত্ত্বেও জোর করে
ঢুকে ওদের কমন ল্যাপটপটা অন করতে করতে দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগল প্রশান্ত— ‘তোমাদের
প্রবলেমটা কী বলো তো? তোমাদের দাঁত, নখ, শিংগুলো দেখা যায় না আর ওর শিংদুটো দেখা
যেত— এই তো?’
একটা ফোল্ডার খুলে বলল— ‘দেখো!’
নন্দিনী দেখল ফেসবুক থেকে ওর সব ছবিগুলো একটা কোলাজ মতো করা রয়েছে।
সামান্য জিনিস। এইরকম বানানো শক্ত কিছু নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওর বুকটা
মুচড়ে উঠল।
প্রশান্ত তখনও বলে চলেছে— ‘মানুষ খুব সস্তা, না? যখন চাইলাম কাছে টেনে
নিলাম, যখন চাইলাম ছুঁড়ে ফেলে দিলাম।’ বলতে বলতে একটা ওয়ার্ড ডকুমেন্ট খুলে দিয়ে
বলল— ‘দেখো!’
নন্দিনী একঝলক দেখে মনে হল সুশান্তকে করা ওর এসএমএসগুলো সুশান্ত খুব সুন্দর
করে সময় তারিখ অনুযায়ী পরপর সাজিয়ে রেখেছে। চোখ উপচে পড়ল জলে। নিজেকে সামলানোর
কোনও চেষ্টাই করল না সে।
—‘নাও মিস নন্দিনী চক্রবর্তী, গেট আউট অফ হিয়ার! গেট লস্ট!’ প্রশান্ত ওর
দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে চেঁচাল।
নন্দিনী
বেরোনোর
সময় ঝাপসা চোখে নন্দিনী দেখল পুলিশের লোক এসে গেছে। এবার ওরা সুশান্তকে নিয়ে যাবে। শেষবারের
জন্য ওকে দেখার একটা ইচ্ছে জেগে উঠল ওর মনে। ও এগিয়ে গেল।
সুশান্তর মুখের দিকে চেয়ে ভীষণ অবাক হয়ে গেল ও। তার মনে হল ওর শোয়ানো
মাথাটার চারপাশ দিয়ে যেন একটা আলোর আভা ফুটে রয়েছে, একটা জ্যোতি বেরোচ্ছে। এই
জ্যোতির কথা জানে নন্দিনী। একে ইংলিশে বলে হ্যালো।
তার মনে হল চোখে জল থাকার দরুণ হয়তো সে ভুল দেখছে, তাই দু’হাত তুলে চোখ
মুছতে গিয়েও... থেমে গেল ও... কাল রাতে কীরকম ছোটোলোকের মতো চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে
বলছিল— ‘ওটা একটা রাক্ষস! একটা শয়তান!’ সেটা মনে পড়ে গেল।
থাক। কী হবে! চোখের জল মোছার থেকে প্রায় শেষ মুহূর্তে নিজেকে বিরত করল
নন্দিনী... বুঝতে পারল কাল সে ভুল করেছিল। মারাত্মক ভুল। যে ভুলের কোনও ক্ষমা নেই।
কিন্তু আজ তার দেখায় কোনও ভুল নেই।
ভালো লাগল
ReplyDelete