বাক্‌ ১৪২।। পল সেলানের কয়েকটি কবিতা ।। অনুবাদ- সোনালী চক্রবর্তী



পল সেলান

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের জার্মানির অন্যতম উল্লেখযোগ্য কবি তথা অনুবাদক পল সেলান ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে রোমানিয়ার এক সম্ভ্রান্ত ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিভিন্ন ভাষায় বিশেষত রোমানিয়ান, ফরাসী ও রাশিয়ানে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। উচ্চ শিক্ষার্থে প্যারিস গেলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে দেশে ফিরে আসেন এবং ১৮ মাস বন্দীদশায় কাটিয়ে মুক্তিলাভ করেন কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ততদিনে তাঁর বাবা ও মা দুজনেই হলোকাস্টের বলি হয়ে গেছেন। একটি পাবলিশিং হাউসে যোগ দিয়ে ১৯৪৫ সাল থেকে তিনি নিয়মিত অনুবাদক হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কবি হিসাবে প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। পল ১৯৭০ সালে সেন নদীতে আত্মাহুতি দেন। 'সেলান' তাঁর পিতৃদত্ত উপাধি 'আনসেল' এর ‌‌‍‍এনাগ্রামিক ছদ্মনাম।



সেখানে পৃথিবী ছিলো 


তাদের গভীরে জমি ছিলো আর তারা খুঁড়েছিলো।


তারা খুঁড়েছিলো আর খুঁড়েছিলো,
ফলে, তাদের দিন তাদের থেকে চলে গেলো,
তাদের রাতও।
আর তারা ঈশ্বরের স্তুতি করেনি।
তারা শুনেছিলো এমনটাই যে তিনিই এইসব চেয়েছেন,
তারা শুনেছিলো এমনটাই যে তিনি সবই জানেন।


তারা শুধু খুঁড়ে চলেছিলো আর কিচ্ছু শুনতে পায়নি।
তারা চিন্তাশীল হয়ে ওঠেনি,
কোন সঙ্গীত নির্মাণ করেনি,
নিজেদের জন্য কোন ভাষাও তারা ভেবে উঠতে পারেনি,
তারা খুঁড়েছিলো।


এক সময় নৈ:শব্দ্য এলো, তারপর বিপর্যয়,
আর তারপর সমস্ত সমুদ্র।
আমি খুঁড়ছি, তুমি খুঁড়ছো, এমনকী পোকারাও তো খোঁড়ে।


এই যে একজন, কেউ-ই না, একজনও কেউ না, আবার এই যে তুমি:
সেই পথটা কোথায় গিয়েছিলো যেটা কোথাও নিয়ে যায়নি?

ও তুমি তো খুঁড়ছো এখন, আমিও খুঁড়ছি,
আর আমি তো খুঁড়ছি তোমার দিকে,
আর আমাদের আঙ্গুলে জেগে উঠছে একটা বৃত্ত।



ছায়াচ্ছন্ন মেয়েটির গান


যখন নি:শব্দে একজন এসে টিউলিপটার মাথা ছিঁড়ে দেয়:
কে জেতে?
কে হারে?
কে জানলার দিকে হেঁটে যায়?
কে প্রথম মেয়েটার নাম উচ্চারণ করে?


একজন আমার চুলগুলো পরে থাকে।
এমনভাবে যতটা কারোর হাতে কেউ মৃত্যুকে ধারণ করে থাকে।
যেমনভাবে আকাশ আমার চুলগুলোকে নষ্ট করেছিলো যে বছর আমি ভালোবেসেছিলাম।
সে যেন ঠুনকো অহং এর মত এটা পরে থাকে।


এই একজন জিতে যায়।
একদম হারে না।
জানলার দিকে হেঁটে যায় না।
এ মেয়েটার নাম নেয় না।


একজনের কাছে আমার চোখগুলো রাখা আছে।
দরজাগুলো বন্ধ হওয়ার সময় থেকে তার কাছে সেগুলো আছে।
আঙ্গুলে আংটির মত করে সে ওগুলো ধারণ করে থাকে। 
নীলকান্তমণি আর লালসার মত করে পরিধান করে থাকে;
শরত থেকে সে আমার সহোদর;
দিন আর রাতগুলো যে গুণে চলেছে অবিরত।


এও জিতে যায়।
কক্ষনো হারে না।
জানলার দিকে হেঁটে যায় না।
এই ই শেষ ব্যক্তি যে মেয়েটার নাম নেয়।

আমি যা বলেছিলাম এর কাছেই গচ্ছিত আছে।
সে হাতের নীচে একটা পোঁটলার মত সেটা বয়ে বেড়ায়।
যেভাবে একটা ঘড়ি তার দুর্বিষহ সময়কে টেনে নিয়ে চলে।
কখনই ছুঁড়ে ফেলে না দিয়ে চৌকাঠ থেকে চৌকাঠে সে এটাকে বহন করে চলে।


এ কোনোদিন জেতে না।
সবসময় হারে।
জানলার দিকে হেঁটে যায়।
এই-ই প্রথম মেয়েটার নাম উচ্চারণ করে টিউলিপগুলোর সঙ্গে
যা আসলে কারোর ছেঁড়া মাথা।



চেরী গাছের ডাল-পালায়...



চেরী গাছটার ডাল পালায় কিছু লোহার জুতো কড়কড় করে ওঠে,
সমূহ শিরস্ত্রাণ থেকে গ্রীষ্ম যেন ফেনিয়ে ওঠে তোমার জন্য,
আর আকাশের দরজায় দরজায় কালচে কোকিলটা হীরের ক্ষীপ্রতায় এঁকে চলে নিজেরই ছবি।

পর্ণরাজি থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠা অশ্বারোহীটির মাথা বর্মহীন,
তার ঢালে সে ধারণ করছে শত্রুপক্ষের ধাতব রুমালে বিদ্ধ
তোমার হাসির অস্তরাগখানি।
স্বপ্নবাজদের এক উদ্যান তার কাছে প্রতিশ্রুত ছিলো,
আর সে তৈরি রেখেছিলো তার বর্শা
যাতে গোলাপটি বেয়ে ওঠার পথ পায়।

কিন্তু হাওয়ায় ভেসে খালি পায়ে যে এসে পৌঁছাল
তার সঙ্গেই তোমার মিল সবচেয়ে বেশি।
তার দুর্বল হাত গুলোয় লোহার জুতোর বকলেস লাগান,
সমস্ত যুদ্ধ আর দীর্ঘ গ্রীষ্ম জুড়ে সে শুধু ঘুমিয়ে থাকে,
তারই জন্য চেরী রক্ত ঝরায়।



অগণিত ঋক্ষরাজি 


আমি ছিলাম,
অজস্র অজস্র নক্ষত্র পুঞ্জ যেখানে আমাদের ধরে রেখেছিলো,
আমি তোমার দিকে তাকিয়েছিলাম-ঠিক কখন?
অন্যান্য সমস্ত পৃথিবী যখন আমাদের কাছে নিছক বহিরাগত।


এই রাস্তা ছায়াপথের,
এই মুহূর্ত আমাদের নামের মধ্যে থাকা দায়ের সমান ভারি
এক রাত্রিকে মেপে চাপিয়ে দিচ্ছে আমাদের উপর।
আমি জানি, কিছুই সত্য নয়।
আমরা যে বেঁচেছিলাম,
আমাদের নড়াচড়া, অন্ধের ভূমিকায়,
থাকা আর না থাকার মধ্যবর্তী অবস্থানে
একটা শ্বাসের অতিরিক্ত আর কিছুই ছিলো না।
আর কোন কোন সময়ে
আমাদের চোখগুলো কবন্ধের মত শোঁ শোঁ করতো
ফাটলে নিভে যাওয়া বস্তুগুলোর দিকে তাকিয়ে,
আর যেখানে সেগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যেতো
গুলজার হয়ে থাকতো বহু বাঁট।
যা হয়েছিলো, যা হচ্ছে অথবা যা হবে,
যার উপর নির্ধারিত হয়,
সেই সময় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো।


আমি জানি,
আমিও জানি আর তুমিও জানো, আমরা সবাই জানি,
আমরা জানতাম না,
আমরা সেখানে ছিলাম,
আর তাছাড়া,
সেখানে তো আমরা ছিলামই না।
আর কখনো কখনো যখন
শুধুমাত্র শূন্যতা আমাদের মধ্যে এসে দাঁড়াত
আমরা একে অপরের কাছে নির্ভুল পৌঁছে যেতে পারতাম।


অথ কলস উপাখ্যান 


সময়ের দীর্ঘ টেবিলে,
ঈশ্বরের কুঁজোগুলো অবাধ মদ্যপানের প্রতিযোগিতায় নেমেছে ।
তারা পান করে খালি করে দিচ্ছে
জীবিত চোখগুলোর দৃষ্টি, অন্ধদের অক্ষিগোলক,
নিয়ন্ত্রণকারী অন্ধকারদের হৃদয়,
সন্ধ্যার অপ্রকৃত গন্ডদেশ।

তারা সর্ব শক্তিমান মাতাল।
তাদের মুখবিবরের মতোই তারা শূন্যতা আর পূর্ণতাকে সমানভাবে ধারণ করে,
আর কখনোই আমার বা তোমার মত উপচে পড়ে যায় না।

28 comments:

  1. সোনালী, আপনার অনুবাদ যত পড়ছি মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। কী বলি! নিকানোর পাররার অনুবাদে বুঝিয়ে দিয়েছেন আপনার শক্তি। ওই অনুবাদ করার মতো কেউ নেই এখন।
    সেলানের কবিতাও মন দিয়ে পড়লাম।
    কী জানাই আপনাকে! নমস্কার নিন।

    ReplyDelete
    Replies
    1. একা আপনিই পড়েন, তবু তো পড়েন, এটুকুই প্রাপ্তি । নমস্কার নেওয়ার কি যোগ্যতা আছে? বরং উল্টো টাই সমর্থিত। আপনাকে দিলাম।

      Delete
    2. বাঃ, যথাযথ, অথচ স্বকীয়

      Delete
  2. অসাধারণ অনুবাদ

    ReplyDelete
  3. "তারা শুধু খুঁড়ে চলেছিল---তারা চিন্তাশীল হয়ে ওঠেনি,/নি কোনো সঙ্গীত নির্মাণ করেনি/ নিজেদের জন্য কোনো ভাষাও তারা ভেবে উঠতে পারেনি"
    "যখন নিঃশব্দে একজন এসে টিউলিপটার মাথা ছিঁড়ে দেয় /কে জেতে?-----যেভাবে একটা ঘড়ি তার দুর্বিষহ সময়কে টেনে নিয়ে চলে।/কখনই ছুঁড়ে ফেলে না /সেই প্রথম নাম উচ্চারণ করে টিউলিপগুলোর সঙ্গে, যা আসলে কারো ছেঁড়া মাথা"
    "---কিন্তু হাওয়ায় ভেসে খালি পায়ে যে এসে পৌঁছে তার সঙ্গেই তোমার মিল সবচেয়ে বেশি /তার দুর্বল হাতগুলোয় লোহার জুতোর বকলেস লাগান "
    এরকম অজস্র লাইন উদ্ধৃত করা যায় হয়ত । কিন্তু তার থেকে বোঝানো যাবে না কী অসাধারণ হয়েছে অনুবাদগুলি ।��

    ReplyDelete
  4. পড়া হয়ে গেলে বাকশক্তি হারিয়ে যায় যে। বারবার পড়বার পর মনে হয় এমন অনুবাদ কীভাবে দেখলাম আর পড়লাম। ভালো থেকো।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আশীর্বাদ থেকে কখনো যেন বঞ্চিত না হই

      Delete
  5. ভালো কবিতা।ভালো অনুবাদ।
    এসব কবিতা আমাদের পড়তেই হবে।
    একদিন শুধু শুদ্ধ কবিতাই থাকবে।
    শুভেচ্ছা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. প্রণাম নেবেন। খুব আনন্দ পেলাম।

      Delete
  6. অসাধারণ লাগলো, দারুন অনুবাদ বরাবরই

    ReplyDelete
  7. অসম্ভব সুন্দর লাগছে দুঃখের ভাষা কবির

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনার সুন্দর লেগেছে খুবই ভালো লাগল

      Delete
  8. তোমার অনুবাদগুলো পড়ে ভালো লাগল । সেলান অনুবাদ করা বেশ কঠিন, মানে ওনার কষ্টকে ধরতে পারা সহজ নয় । আমি Death Fugue অনুবাদ করে হাল ছেড়ে দিয়েছিলুম ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. চেষ্টা টুকু করেছি মাত্র। কতটুকু হয়ে উঠেছে জানি না...

      Delete
  9. খুব ভালো লেগেছে অনুবাদ , জটিলতাগুলোর ডিলগুলি সাবলীল মনে হয়েছে , সেলান যেন বাংলায় বলছেন বাংলা কবিতা

    অনুবাদে একটু তাড়াহুড়ো ছিল মনে হলো তবে কবিতা সিলেকশান সেটা পুষিয়ে দিয়েছে,তার উপর সেলান অনুবাদ !!

    Grüß dich, mach weiter.


    ReplyDelete
  10. নতুন করে কিছু বলার নেই সোনালীর অনুবাদ নিয়ে । আমি আগাগোড়াই মুগ্ধ সোনালীর অনুবাদে । তবু, এই কবিতাগুলো একটানা পড়ে গেলাম । কারণ ,লেখাগুলো অনুবাদে জীবন্ত হয়ে উঠেছে । এই প্রাণপ্রাচুর্য শুধু সোনালীর অনুবাদ বলেই সম্ভব ।

    ।। শুভদীপ নায়ক ।।

    ReplyDelete
    Replies
    1. বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলাম, শুভদীপের রিএকশন নেই। যাক, বৃষ্টি এলো, ঘুম শান্তির হবে

      Delete
  11. Aritra chatterjee5 June 2020 at 07:25

    অনুবাদগুলি সুন্দর, পড়ে খুব ভালো লাগলো

    ReplyDelete
  12. আপনার কাজকে আমি সবসময়ই আন্তরিক সম্মান জানাই।। এ তো অসম্ভব ভালো প্রয়াস।। পড়ে যে কী সমৃদ্ধ হলাম! —প্রীতম

    ReplyDelete
    Replies
    1. কী যে বলেন মায়াময় কবি, পেখম মেলতে ইচ্ছে করে...

      Delete
  13. অনুবাদ এতো সুন্দর হতে পারে !
    অনুবাদ তো এমনই হওয়া উচিত ।
    পল সেলান-এর আত্মা যেন সোনালী চক্রবর্তীর শরীরে স্থাপিত হয়েছে ।
    তোমার লেখা সেভাবে পড়া হয়ে ওঠেনি । এবার পড়তে চাই ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, শুভেচ্ছা, প্রীতি

      Delete