বাক্‌ ১৪২ ।। সুকৃতি ।। মোমবাতির আয়ু


ঘোর কেটে গেলে অনেক সময় ভয় কেটে যায়। আবার ঘোর কেটে গেলে ভয় জেগেও ওঠে।এটা হলো যুক্তিগত ভয়। এই দুয়ের মাঝামাঝি একটা পর্যায় আছে। আমি ঠিক সেই জায়গায় বসে আছি, আমার দোতলার ঘরে। যখন আমার ডান দিকে খোলা দরজার বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আর বাঁ দিকে টেবিলের কোনার দিকে একটা মোম তার আয়ুর সুতোয় আত্মার মতো একটি শিখাকে ধারণ করে আমাকে লিখতে সাহায্য করছে ঠিকই কিন্তু নিজে জীবনের জ্বালায় কাদঁতে শুরু করেছে।

আমি চেয়ারটা আরেকটু ডানদিকে দরজার কাছে এগিয়ে নিলাম, যাতে, হঠাৎ যদি বিদ্যুৎ চমকায়, আমি পল্লাটা ঠেলে দিতে পারি। চিন্তাটা আসলে একটা বোকামি। কিন্তু নিজের প্রতি কখনও কখনও একটা অন্ধবিশ্বাস কাজ করে। তখন নিজেকে প্রকৃতির আত্মীয় মনে হয়। তবে দরজার দিকে চেয়ার নিয়ে এগিয়ে আসার পরোক্ষে একটি যুক্তি আছে বৈকি। সেটি হলো মোমবাতির কান্নায় হঠাৎ বাইরে থেকে আসা দমকা বাতাস না ব‍্যাঘাত ঘটায়।


ওই যে আবার একটা বিদ‍্যুৎ চমকালো। আমি দরজা ঠেলে দিতে না দিতেই গুড়ুম-গাড়াম পড়াও সারা। তারপর জোর বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। সারা ছাদ ভরে জ‍্যান্ত বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে আর অর্ধ-বৃত্তাকারে ভেঙে যাচ্ছে। সব বৃষ্টির ফোঁটা কিন্তু পড়েই মিলিয়ে যায় না। তার আগে বেলুনের মতো একবার ফুলে ওঠে। শুনেছি এইসব বেলুনের মতো ফুলে ওঠা বৃষ্টিবিন্দুগুলো নাকি পূর্ব জন্মের কথা মনে পড়িয়ে দিতে পারে। কাউকে কাউকে মনে পড়িয়ে দ‍্যায়। যদিও একথায় আমার বিশ্বাস হয় না সে অনেক বছর হয়ে গেল। অবশ্য ততদিনে এইসব গল্প বলা বোষ্টেমদাদু পটলডাঙার টিকিট কেটে চলে গেছে। তার আগে আমাদের বাড়ি মাঝেমাঝে আসতো। ওপার বাংলার হিসাবে, ঠাকুমার কেমন গ্রামতুতো ভাই হয়। সেই সূত্রে আমার কুঁজো ও ছোটো হয়ে আসা ঠাকুমাকে উনি দিদি বলতো এবং বাবা-জেঠুরা তাঁকে বলতো মামা। যদিও আমার ঠাকুরদা-ঠাকুমা এপারে আসার অনেক পরেই উনি ওপার বাংলা থেকে যথাসম্ভব একাত্তরের ঝামেলার সময় পালিয়ে এসেছিলেন।


প্রায়ই সকালে বোষ্টেমদাদুকে দেখতাম, দুটো বলদ নিয়ে আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে মাঠে কাজ করতে যেতো। আমাদের বাড়ি থেকে সোজা একটু জোরে হাঁটলে মোটামুটি দশ-বারো মিনিটে বোষ্টেমদাদুর বাড়ি পৌঁছে যাওয়া যায়। একবার গেছিলাম ছোট কোনও একটা অনুষ্ঠানে। বড়ো রাস্তা থেকে নেমে, সরু একটা রাস্তা দিয়ে হেঁটে মাঠের পাশে বড়ো বড়ো গাছ আর বাঁশঝাড় পরিবৃত্ত একটা জায়গায় অন্ধকারময় ঘরবাড়ি। আমাদের বাড়ি এমনিতেও আসতো আর মাঝেমধ্যে মজুরির বিনিময়ে আমাদের কাজও করে দিত। বিচালির পালা দিয়ে দিত। কখনও কখনও এসে একসাথে বেশ কয়েকদিনের বিচালি কেটে দিত। গরুর ডাক উঠলে গরুকে নিয়ে যেত ষাঁড় দেখাতে। 


এইসব দিনগুলোতে, বোষ্টেমদাদুর সকালের চা-রুটি থেকে শুরু করে দুপুরের ভাত ও বিকালের চা-মুড়ি খাওয়াও আমাদের সাথেই বাঁধা ছিল। কেবল আমাদের নয়, পাশাপাশি দুই জেঠুর ঘরেও টুকিটাকি কাজের সুবাদে ওঁর যাতায়াত ছিল। তবে আরও একটি কাজের সুবাদে বোষ্টেম দাদুকে দরকার পড়ত। তা হল, আমরা বাচ্চাকাচ্চারা যদি হঠাৎ ভয়টয় পেতাম তো, আমাদের সেই ভয় ঝাঁড়ানোর জন‍্য ঠাকুমা ওপাড়ার কোনও জোনকে দিয়ে বোষ্টেম দাদুকে খবর পাঠাত। বোষ্টেম দাদু সামনে দাঁড়িয়ে মুখে বিড়বিড় করতেন আর ফুঁ দিতেন। এইভাবে তিনবার বিড়বিড় করে তিনবার ফুঁ তো দিতেনই, এমনকি শেষবার, কীসের আনন্দে কে জানে, আরও দু'তিনবার এক্সট্রা ফুঁ দিয়ে দিত! আমার এই ফুঁ গুলো খুবই বিশ্রী লাগতো। ফুঁ তো না, ভকভক করে বিড়ির গন্ধ আছড়ে পড়ত নাক মুখের উপর। কিন্তু কিছু বলতেও পারতাম না। কেবলমাত্র ওই সময়টা শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ রাখতাম আর মুখ খানিকটা বাংলা ৬য়ের মতো রাখতাম ঘুচিয়ে।


একটু বুঝতে শেখার পর বুঝতে পারলাম, আমরা ছিলাম গে' বাড়ির বড়োদের কথা অমান‍্য না-করতে পারা ভদ্র বাচ্চা-কাচ্চার নিদর্শন। বড়োরা, বিশেষ করে মা-কাকি-জেঠিরা এমনভাবে সবার সামনে একটা ভদ্র ছেলের পোশাক পরিয়ে দিত, যার ফলে আমরা তখন অন্য বাচ্চাদের সাথে হৈ-হট্টগোল করে খেলায় সামিল হতে গিয়েও দ্বিধান্বিত হয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতাম। কেবলই একটা আশঙ্কা কাজ করত যে, এদের সাথে এভাবে খেলতে গেলেই বুঝি অভদ্রতা বেরিয়ে পড়বে। যদিও বা কদাচিৎ কখনও পাশের মাঠে খেলতে যাওয়ার ছাড়পত্র পেতাম, সেটাও বোষ্টেম দাদুর বিকাল বেলায় চা খেতে আসার সুবাদে। পঁয়ষট্টির বেশি বয়স হয়ে গেলেও মূল শরীরে বেশ মজবুতই ছিলেন। সন্ধ্যা হওয়ায় আগেই উনি আবার আমাদের নিয়ে বাড়ি চলে আসতেন।


তবে বোষ্টেম দাদুকে আমরা একটি বিশেষ কারণে সমীহ করতাম। সেটা হল, বোষ্টেমদাদু ভূতের মন্ত্র জানতেন। আর ভূতের গল্পও বলতেন আমাদের। বাংলাদেশে থাকতে নাকি একাবার ভূতের সাথে মারামারিও হয়েছিল। তখন তো আমাদের এলাকায় ঘরে ঘরে কারেন্টের লাইনও পৌঁছায়নি। হেরিকেনের আলোয় আমি ও জেঠুর ছেলে পাশাপাশি বসে বোষ্টের দাদুর মুখে ভূতের গল্প শুনতাম। গল্প নয়, সত্যি ঘটনা। হেরিকেনের ঢিমে আলোয় সেই গল্প আরও মোহময় হয়ে উঠত। মাঝেমাঝে আমরা ভাইরা এরওর মুখের দিকে চাইতাম আর শুকনো ঢোক গিলতাম।


একজন ভূতের মন্ত্র জানা লোকের মুখ থেকে অন‍্য একজন ভূতের মন্ত্র জানা পরাক্রমশালী লোকের ঘটনা শুনতাম। সেই ভূতের মন্ত্র জানা লোকটা ভূতেদের দিয়ে নানারকম কাজ করিয়ে নিতে। তার মন্ত্রের দাপটে অনেক ভূতকে বেগার খাটিয়ে রাতারাতি বড়ো বড়ো পুকুর কাটিয়ে নিতেন। মন্ত্রের জোরে ভূতকে দিয়ে আরও কঠিন কঠিন কাজ করিয়ে নিত। এমনকি ভূতকে দিয়ে নানা কাজ করানোর মধ্যে একটি নিয়মিত বিলাসীতা ছিল, রোজ বিকালে ভূতের কাঁধে চড়ে ঘুরতে বেরোনো। এসব কারণে ভূতেরা তাঁর উপর রেগে তো থাকতো কিন্তু লোকটার মন্ত্রগুণের প্রভাবে তাঁর কিছু করতেও পারতো না! অথচ একদিন বিকালে ভূতের কাঁধে চড়ে ঘোরার সময়ই মন্ত্রজ্ঞানীর কাল ঘনিয়ে এল।


সেদিন তাড়াহুড়োয় ভূতের কাঁধে চড়ে বসার আগে সে সঙ্গে করে মন্ত্রপড়া মাটি নিতে গেল ভুলে। ভূতের কাঁধে চড়ে ঘুরবার সময় ভূতটা হঠাৎ বুঝতে পেরে গেল যে কোথাও কোনও গড়মিল করেছে লোকটা। ফলে আর দ্বিতীয় সুযোগ নয়। ভূতে লোকটার দুই পা ধরে সোজাসুজি পা উপর দিকে করে ঘাড় মটকে মাথা মাটির ভেতরে ঢুকিয়ে দিল।
আমার উৎসুক মন জানতে চাইল, ভূতে কীভাবে বুঝতে পারলো যে লোকটা মাটি পড়া নেয় নাই?
দাদু বলতে থাকলো, যখন লোকটা ভূতের ঘাড়ে করে ঘুরছিল, তখন হঠাৎ একটা পাখি লোকটার মাথার কাছ ঘেঁষে উড়ে যেতেই লোকটা উঠলো কেঁপে। আর ভূতেও বুঝতে পারলো, এটাই সুযোগ। সব বেগার খাটা ভূতের হয়ে বদলার সুযোগ আর হাতছাড়া করেননি ওই কুলি ভূত।

এসব খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে তখন ভালো লাগলেও, সেই অর্থে ভয় জাগতো না। উল্টে ভূতের জন‍্য আমাদের মনে এক অপ্রয়োজনীয় ব‍্যাথার বাতাস বইতো মাত্র। আমরা আরও ভয়ের গল্প শুনতে চাইতাম। যেমন, অনেক রাত্তিরে পুরোনো বাড়ির লম্বা বারান্দা দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ চুড়ির ঝনন শব্দ ভেসে এলোকোথা থেকে আসছে বোঝার চেষ্টা করতে গিয়ে পাশের কোনও একটা ঘর থেকে শোনা গেল মেয়েলী কন্ঠের হাসি। ভেতর দিয়ে বন্ধ জানলার ছোট্ট ফাঁকটায় চোখ রাখতেই দেখা গেল, একটি বড়ো উনুনের সামনে সদ‍্যবিবাহিতার মতো লাল বেনারসী শাড়ি পরে একজন সুন্দরী রমণী বসে হাসছে। জানলার ছোট্ট ফাঁকা দিয়ে মুখটা ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। ফলে ব‍্যাপারটা জানার জন‍্য ও চুপিচুপি দেখার চেষ্টা করতে গিয়ে সেই জানলার পাল্লা যতটা সম্ভব ঠেলতেই পুরো খুলে গেল! আর সেই সদ‍্যবিবাহিতা সুন্দরী রমণী তাকিয়ে পড়ল জানলার দিকে। যে তখনও সেই জ্বলন্ত উনুনের মধ্যে নিজের পা ঢুকিয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে চলেছে


আর এই সব গল্প শোনার যে সাইড এফেক্ট যেটা হয়, সন্ধ্যার পর হিসিফিসি পেলে একা একা ঘর থেকে বেরোতে ভয় পেতাম। বারান্দার কোনে দাঁড়িয়ে দেওয়ালের দিকে পাশ ফিরে কোনও মতে হিসিত করে দৌড়ে ঘরে ঢুকে পড়তাম। তখন উঠোনের ওপাশে দূরে ওই  কলা পাতাটাও মায়াবী জোৎস্নার নিচে এমন ভাবে দুলতে থাকে, দেখে মনে হয় কিছু দিন আগে স্কুল পাড়ায় গলায় দড়ি দিয়ে মরা পূর্ণিমার প্রেতাত্মা দুলছে।


তবুও আমাদের ভূতের ভয় যেন বড়ো প্রিয় ছিল। আমরা আরও আরও বেশি ভয়ওয়ালা ভূতের গল্পের প্রতি ধাবিত হতাম। গল্প শুনতে শুনতে তখন তো আর গল্প মনে হতো না। আমাদের জ্ঞানের আড়ালে ঘটে যাওয়া ঘটনার কাল্পনিক চলচ্চিত্র ছিল সেই সব। ভূতের খপ্পরে পড়া যেমন সাংঘাতিক ঘটনা, তেমনি সেই খপ্পর থেকে মুক্ত হয়ে আসাটাও বীরত্বের ব‍্যাপার। আহা এমন গ্রামীণ বীর আর কয়জন আছে!


সেই বোষ্টেম দাদুও একদিন মারা গেল। আমরাও বড়ো হয়ে উঠছিলাম। আমরাও ভূত থেকে ক্রমে পেত্নিদের গল্পের দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়ছিলাম। আমরাও ধীরে ধীরে বিশ্বাস করতে ভুলে যাচ্ছিলাম, ভূত-প্রেত বলে কিছু আছে। অথচ ভূতের ভয় তখনও একটু আধটু ছিল। এও এক সরলতা। ধীরে ধীরে সেই সরলতাও একদিন আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেল। আর কবে থেকে যেন ভূতের ভয় পাওয়াও ভুলে গেলাম আমরা।


আজ জীবন মধ্যাহ্নে এসে বুঝি ভূতে আর কোনও ভয় অবশিষ্ট নাই। সব শেষ। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, ইদানিং টের পাই, ভূতের প্রতি কেমন একটা যেন বিশ্বাস জন্মাচ্ছে! পঞ্চভূতের প্রতি বিশ্বাস প্রগাঢ়তম হয়ে উঠেছে ক্রমশ। দরজার ফাঁক দিয়ে ছিটেফোঁটা বৃষ্টির ছাট আসছে ঘরে। শেষ হয়ে আসা মোমবাতির কান্না টেবিলের কোনা বেয়ে গড়িয়ে পড়তে গিয়েও থমকে গেছে। কিছুটা গলন ছুঁয়ে টেবিলের কোনায় সুতোটা তখনও জ্বলছে।

3 comments:

  1. অর্ঘ্য দত্ত8 June 2020 at 20:17

    ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
  2. ভূত আমাকে চিরকালই আকৃষ্ট করে। এমন ঝরঝরে গদ্য যা কিনা পাড়াগাঁয়ের সারল্যে ভরা আত্মকথা তা তো মন ছুঁয়ে যাবেই।

    ReplyDelete