বাক্‌ ১৪২ ।। ডালটন সৌভাত হীরা ।। দেবব্রত গাঙ্গোত্র




এক

দ্রাক্ষ দেশের পরেই কবাক্ষ দেশ। দ্রাক্ষ'র উষরতা এখানে নেই। বরং শান্ত সুশোভন বৃক্ষরাজি,এবং ততোধিক শান্ত মানুষ, কবাক্ষকে, এক সুধীর বদ্বীপ করেছে।দেবব্রত দক্ষিন দেশে আগেও এসেছে। তবে ছোট বেলা। সেটা অবশ্য ছিল গান্ধর্ব্ব দেশ থেকে। নৌ শকটে। দেবব্রতের জীবনের সবচেয়ে বড় সময়টা কাটল এই গান্ধর্ব্ব দেশে। পীত বর্নের,ছোট চোখ,এবং খর্বাকার মানুষের দেশ। মায়ের সাথে সাথে সে ঘুরেছে,নীলাচ সাগরের মত অগ্রবর্তী বালুকাবেলায়... সেখানে তার শৈশবের খেলার সাথী গান্ধর্ব্ব রাজকন্যা মৃক্ষরার সাথে। তার মা, গাঙ্গোত্রী, এখন গান্ধর্ব্ব দেশে স্থাপিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য্য। সমস্ত পীত দেশ, জম্বু দ্বীপ, কৌম্বলদেশ (চীন) এবং আহরত্য ভুমি (আরব) থেকেও জ্ঞানন্বেষী আশ্রমিকরা গান্ধর্ব্ব বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পড়তে আসতে শুরু করেছিল। গান্ধর্ব্বরাজ কুবের পুত্র মৃক্ষকেটু, বিশ্ববিদ্যালয়ে সব রকমের জ্ঞান চর্চার পরিবেশ নিশ্চিত করেছেন। সেখানে সুবিশাল অট্টালিকা, গ্রন্থাগার, প্রযুক্তিবিদ্যা বিভাগ,চিকিৎসাবিদ্যা বিভাগ সবই স্থাপিত। একটু বয়স বেড়ে দেবব্রত গাঙ্গোত্র যখন তরুণ, তখন সে ঠিক করল চিকিৎসাবিদ্যা পড়বে। গান্ধর্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কৌশল বিভাগ ভুবন বিখ্যাত। এখানে পড়ান বৈদ্যকুল শিরোমণি অশ্বিনী কুমার ভাতৃদ্বয়। তারা স্বর্গ ভুমির মানুষ। অসুরদেশ পার হয়ে, সুবাহত্য, তারপর যমালয়, তারপর স্বর্গ। স্বর্গ ভুমির মানুষেরা শ্বেতকায় ও নীল চোখের। তবে অশ্বিনী কুমারদ্বয়ের বর্ন তামাটে, শোনা যায় তারা কোনো কৃষ্ণকায় দাসের বংশধর। একারণে দেবতা হলেও তাদের বর্ণ শুদ্র।


অথচ এই অশ্বিনী কুমার দ্বয়ের কনিষ্ঠ বৃখ অশ্বিনীর প্রতি তার মা গাঙ্গোত্রীর আকর্ষনের কারণ দেবব্রত কখনোই বুঝতে পারেনি। বৃখ অশ্বিনী বয়সে তার মায়ের চেয়ে অনেক কনিষ্ঠ। তাছাড়া ত্রিভুবন বিখ্যাত, এবং তাঁর জ্ঞান ও প্রযুক্তি কৌশলে পারদর্শীতার জন্য প্রবহমান জলের দেবী বলে আখ্যায়িত জ্ঞান-তাপসী গাঙ্গোত্রীর গুণের অর্ধেকও বৃখ না। তবুও গাঙ্গোত্রী তাকে ভালবাসেন। হয়ত গাঙ্গোত্রী তার মা না হলে দেবব্রত বুঝতে পারতেন, নারীর অচেনা এই রহস্যের কার্যকরণ। অথবা এই রহস্য ও সমর্পনের ভেদ কোন পুরুষই করতে পারে না।


আচার্য্য নিবাসের শয্যাঘর থেকে গাঙ্গোত্রী বের হলেন। মধ্য চল্লিশা এবং আপাত বিগত যৌবন হলেও ত্রিভুবনের যে কোনো পুরুষের জন্য তিনি কাম্য। সুগঠিত বল্লরী ও সৌষ্ঠবে, এবং একই সাথে তীক্ষ ভেদ করা চোখে পৃথিবীর এক অদ্ভুত কর্তৃত্ব নিয়ে যেন তিনি বসে আছেন।

দেবব্রত তুমি তোমার পিতার মতো হয়েছ। একগুঁয়ে এবং প্রচন্ড আবেগী।

দেবব্রতর কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে না।

তোমাদের আসলে কোনো কিছু বলে কোন লাভ নেই।


দেবব্রতর বলতে ইচ্ছে করল, সে নিষেধ কি তুমিও কখনো শুনেছ মা? আমার পিতা হস্তিনাধিপতী শান্তনুর আবেগ এবং প্রেমের মুল্য কি তুমি দিয়েছ? কেন তিনি ক্ষত্রিয় বলে? নাকি তোমার প্রাজ্ঞতা ও জ্ঞানের সাথে তিনি তুলনীয় নন। তাহলে তাকে বিয়ে করেছিল কেন? কেনই বা সন্তানের জন্ম? তিনি ত সারাজীবন তোমার জন্য অপেক্ষা করেছেন। এখনো অপেক্ষা করে যাচ্ছেন। শোনা যায়,অন্য নারীর বশ-বর্তিনী তিনি হননি। তুমি তো হয়েছো। অসংখ্য ব্রাহ্মণ জ্ঞানী, ঋষি দেব।

মা, তোমার মহর্ষি ভরদ্বাজের কথা মনে আছে? জ্ঞানতাপস মহর্ষি ভরদ্বাজ, বৈদিক অষ্টম সূত্রের প্রধান রচয়িতা। যখন তুমি তার সঙ্গিনী হয়ে পারস্য দেশে, তিনি প্রধান আচার্য্য অসুর রাজ বালি প্রতিষ্ঠিত বিহারের... তখন প্রতিরাতে মদ্যপ অবস্থায় তোমার প্রতি অত্যাচারের সাক্ষ্য আমি।তবুও তোমার কাছে মহর্ষিই ভাল ছিলেন। তিনি জ্ঞানী,সুক্ত প্রবক্তা ঋষি। আর আমার পিতা সাধারণ ক্ষেত্রজ এক যোদ্ধা। তার গৃহে পতিধর্ম পালন করলে তোমার হয়ত সম্মানহানি হয়। তারপর মনে হচ্ছে, এরকম অজস্র দেশে তুমি ঘুরেছো। অসুররাজ বালির মক্ষিকা হয়েছো। তিনি তোমাকে সম্মান দিয়েছেন? যখন তার উপপত্নীরা তোমাকে হত্যাদ্যত, তখন কিশোর আমিই শস্ত্র তুলেছি। তবুও তুমি পিতার কাছে ফিরে যাওনি। মূর্খ ক্ষত্রিয়ের কাছে হয়ত ভুবনখ্যাতা বিদূষী গঙ্গার যেতে নেই। তিনি ঈন্দ্রের অক্ষিনী হবেন দরকার হলে। আমার পিতার কাছে নন।

-পুত্র তোমার জিজ্ঞাসা কি বৃখ অশ্বিনী কে নিয়ে

-হ্যাঁ, উনি আমার বয়সে সামান্য বড়। তোমার ভর্ত: হিসেবে নিতান্ত বেমানান মাত:

-বাহহহ! পুত্র! তুমি ধীরে ধীরে পুরুষ হয়ে উঠছ। তোমার পিতা মহারাজ শান্তনুও হয়ত এমনি ভাবতেন। বেমানান? হা! হা!অজস্র রাজন্য গৃহ তুমি ঘুরেছ। তাদের রাজ অন্তপুরে মহিষীগণ কি কখনো তাদের কন্যাতুল্য বয়সী নন? তাহলে এ সুবিধা কি শুধু একজন পুরুষ ভোগ করবেন? সম্পর্ক নির্নয়ের অধিকার?

- আমি মহর্ষি শ্বেতকেতুর অনুসারী। তিনি নারী ও পুরুষের দুজনকেই প্রকৃত একগামী হতে বলেছেন।

- একগামী? হা হা!সারা জীবন এক পট্টবস্ত্র তোমার ভাল লেগেছে? এক রঙ? তাহলে এক সম্পর্ককে ভাল লাগবে কেন? শ্বেতকেতু নিয়ম করেছিলেন তার মাতা বিদূষী শঞকা র উপর রাগ করে। ভাল কথা তুমি থাকতে পারবে আজীবন একগামী?

-আমি ব্রহ্মচারী মাতা।

-হা!হা! সেটা ভর্য্য কুল শিরোমনি ঋষি বিশ্বমিত্র ও বলতেন। আমি চাই তুমি মৃক্ষরাকে গ্রহন কর বালুকাবেলায়। অন্তত আজ রাতে। তুমি প্রকৃত পুরুষ হও।

এই সংক্ষোভ ও লাজুকতায় দেবব্রত নিশ্চুপ হল। তার আসলে তার মাকে জানানো দরকার তার প্রিয় বন্ধু দশানন পুত্র, অক্ষয় কুমারের মৃত্যুর কথা। এক অনার্য যোদ্ধা হনুমানের হাতে সে নিহত হয়েছে। অথচ গান্ধর্বতা চিকিৎসা অনুষদ থেকে সে এই গ্রীষ্মেই লঙ্কা গিয়েছে। তার পিতা সম্রাট দশানন কোন এক কারনে আটকে রেখেছেন সীতা নামের এক নারীকে। সেই সুত্রেই এই রক্তক্ষয়, যুদ্ধ দামামা। অক্ষয় কুমারের দু:খী মাতা মন্দাধরী কেমন আছেন কে জানে? সম্রাট দশাননের অন্ত:পুরের সহস্র নারীর মধ্যে এই পুত্র হারা দুখিনীর কথা হয়ত কেউ মনেই রাখেনি।

গাঙ্গত্রী তার পুত্রের কাছে আসেন। তার পাশে দাঁড়ান।এবং হঠাৎ করেই যেন কেঁদে ওঠেন। এবং কিছুক্ষণ পরে সে কান্নাও সামলান তিনি।

-পুত্র! শুনবে তুমি, কেন আমি তোমার পিতা মহারাজ শান্তনু কে ছেড়ে চলে এসেছিলাম? তোমার পিতা শ্বেতকেতুর আর্য্য দর্শনের অনুগামী। তার রাজ:অন্তপুরে পত্নী আমি একাই। কিন্তু তিনি তাঁর সম্ভোগ ক্ষুধা মিটাতেন তার দাসীদের দিয়ে। শুদ্র দাসী। এই পৃথিবীর তুচ্ছার্থক মানুষের দল। এবং উনি বলতেন, দাসীসম্ভোগ শাস্ত্রসিদ্ধ। হায় রে আমার শাস্ত্র। তোমার দুধমাতা ছিলেন এক শুদ্র দাসী। নাম ত্রক্ষরা। তার গর্ভে মহারাজের এক কন্যা জন্মে। এবং মহারাজ কন্যা এবং ত্রক্ষরা দুজনকেই মেরে ফেলার আদেশ দেন।

শুনেছো পুত্র!তোমার মহাত্মন পিতার কাহিনী। তুমি আমার কথা ভাবছ? মহর্ষি ভরদ্বাজের সঙ্গিনী আমি কেন হয়েছিলাম? সেতো তোমার জন্যেই। মহর্ষি তোমাকে ত্রিভুবনের শ্রেষ্ঠ দর্শন বিদ্যা শিক্ষা দিয়েছেন। একইভাবে অসুর সম্রাট বালি, তোমাকে অস্ত্র বিদ্যা। তোমার শুদ্রকে মানুষ্য প্রজাতি না ভাবা পিতার চেয়ে তারা মহৎ। আমি শুদ্রকন্যা। আমার পিতা দেবাদিদেব আদিত্য শুদ্র বংশোদ্ভুত। তিনি নিজ কর্মগুনে দেবত্ব পান। আমিও নিজের কর্মগুণেই দেবী হয়েছি। আমাকেও শুদ্র দেবী হিসেবে কম তুচ্ছ করেনি অপরাপর দেবরা। এইজন্যই আমি বুঝি শুদ্রের মন:বেদনা। শুদ্র দাসের কান্না কখনো পড়েছ পুত্র!

আমি বৃখ অশ্বিনী কুমারকে ভালবাসি পুত্র... ভালবাসি সেই তামাটে রঙ। শুদ্র দাসদের।

তুমি ভালবাসতে পারবে কোন শুদ্র দাসী? তাকে অন্ত:পুরে নিতে পারবে? নাকি তুমিও তোমার পিতার মতো, ভীত ও মূক।

গাঙ্গোত্রী কাঁদছেন। সাগরের মত সলিল রূপা এ কান্না। তাকে ভেদ করার ক্ষমতা পুত্রের থাকে না কখনো।

তুমি মুক্ত পুত্র! আজ থেকে! তোমার পিতার কাছে যাও। হস্তিনাপুর। এবং সম্ভব হলে পুরুষ হও। প্রকৃত পুরুষ।

দুই

গান্ধর্ব দেশ থেকে লঙ্কার যাত্রাপথ দীর্ঘ। কয়েক মাস লেগে যায়, সমুদ্রগামী জাহাজে করে যেতে। আহরত্য নাবিকদের এক জাহাজে চড়ে দেবব্রত যখন লঙ্কা পৌঁছাল, সেদিনই লঙ্কা যুদ্ধ শেষ হয়েছে। প্রতাপশালী দশানন রাবণের সমস্ত প্রদীপ নিভে গেছে। অনার্য কালো বর্নের দ্রাবিড় সৈন্য, তাদের মর্কট খঞ্জিত পতাকা হাতে জয়োল্লাস করছে। ওপাশে আরেক কালো ও তামাটে বর্নের রাক্ষস সেনারা। মাঝখান থেকে জিতলেন শাদা গাত্র বর্ণের এক আর্যপুত্র। তাকে বলা হচ্ছে মর্যাদায় পুরোষত্তম। হয়ত তারো দেবত্ব প্রাপ্তি ঘটবে ভবিষ্যতে।

---
দেবব্রত যখন লঙ্কায় পৌঁছাল তখন সন্ধ্যা সমাগত প্রায়। ত্রয়স সাগর কুলে তখনো বানর এবং রাক্ষস সেনাদের লাশ পড়ে আছে। পুর্বদেশ থেকে আসা পাহাড়ি শকুন সেখানে অপেক্ষারত। হয়ত কোন ঈঙ্গিতের--যুদ্ধ বা জীবনের শেষের। যখন জাহাজ থেকে সে নামছে, তখন সৈকতে দেখেছে, লঙ্কার রমণীদের। তারা তাদের স্বামী ভ্রাতা ও পুরুষের লাশ খুঁজতে এসেছে। যুদ্ধ ও রক্ত, মানুষকে কখনো তার পুর্বত্বকে খোঁজায়, সে তার অতীতে যায়, সেখান থেকে বর্তমানে ফেরে। আহিরত্য নাবিকদের মুখেই সে শুনেছে এক সময়ের স্বর্ণলঙ্কা এখন কঙ্কাল, রাজকোষে মুদ্রা নেই। খাদ্যশালায় খাদ্য নেই। অনেক পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিই হত।

আদাইল নামের এক আহিরত্য নাবিককে জিজ্ঞেস করল দেবব্রত, এই লঙ্কার মেয়েরা ঘাটে জাহাজ ভিড়লেই ভিড় করছে কেন?

তারা অন্ন চায়, আর্য,পরিধানের বস্ত্র চায়। তাই দুরদেশী নাবিকদের শয্যাসঙ্গিনী হওয়ার জন্যই তাদের এত কাড়াকাড়ি। একসময়ের রাজ অমাত্য, ধনবান রাক্ষসাধিপতি ঘরের নারীরাও, আসছে। তাদের আসলে খুব করার নেই বেশি কিছু। ক্ষুধা এক মৌলিক চাহিদা আর্য্য। এ ক্ষুধার কাছে সবাই আসলে পরাভুত।

দেবব্রত কিছুক্ষন নিস্তব্ধ থাকল। মানুষের অসহায় ক্রন্দন এখন তার কাছে সাগরের জলের চেয়েও ভারী লাগছে। কিছুক্ষন আগেই আহিরত্য জাহাজে তার সাথে সৌদ্রক্ষী নামে এক রাজসেনাপতির স্ত্রীর সাথে পরিচয় হয়েছে। সৌদ্রক্ষী ও আরব জাহাজে এসেছে খাদ্যের খোঁজে। যমের এবং গমের রুটি, সেটুকুই তার শিশু পুত্রের জীবন বাঁচাতে পারে। কিন্তু মধ্যত্রিশা সৌদ্রক্ষী কিছুটা বেমানান হয়ত এ শয্যা বিপণনে।

-আমি তোমাকে খাদ্যের বিনিময় মোহর দেব। আমার কাছে গার্ন্ধব্য দেশের মোহর আছে।

-আপনার করূনা আর্য্য। আমার মত বিগত যৌবনাকে আপনি করুণা করছেন,আমি ধন্য।

-আমি তোমার কাছে উপকার চাই

-বলুন শয্যায় যেতে হবে কখন
-আমি ব্রহ্মচারী। তোমাকে শয্যায় চাই না। তুমি আমাকে রানী মন্দোদরীর কাছে নিয়ে যাবে।

***********

 ময়দানব কন্যা মন্দোদরী ব্রিশশিলনী প্রাসাদে। যুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারে প্রাসাদের এক অংশ ভেঙে পড়েছে। মন্দাধরী সেই প্রাসাদে তার জীবনের নতুন কোন পাশার ছকে, নতুন কোন হিসাব মেলাতে ব্যস্ত। সম্রাট রাবণের পর লঙ্কারাজ বিভীষণ তাকে দুটো শর্ত দিয়েছেন; হয় তাকে বিবাহের অথবা নির্বাসনের। রানী মন্দোদরী জানেন, নির্বাসনের কথা বলে তাকে আসলে আরব বণিকদের কাছেই বিক্রি করে দেয়া হবে। এবং তার কন্যাদেরও। পুত্রবধূদেরও। যুদ্ধ ও রাজনীতি রক্তের সম্পর্ককে নিষ্ঠুর করে।

দেবব্রত কথা বললেন রানী মন্দোদরীর সাথে। হয়ত রানী তার মধ্যে হারানো পুত্র অক্ষয়কুমারের ছায়া দেখলেন।

- মাতা,আপনার সিদ্ধান্ত আপনি নেবেন। রাজ সম্পর্ক রক্তের সম্পর্ক মানে না।

দেবব্রত চলে আসার সময় সৌদ্রক্ষীকে রানীর অন্তঃপুরে রেখে আসলেন। এবং তার পুত্রকেও। হয়ত,অচেনা সম্পর্ক,সাগর এবং বাৎসল্য নতুন মায়ার জন্ম দেয়।

*****

দেবব্রত লঙ্কা ছাড়ছেন। পড়া এবং কঙ্কাল-লঙ্কায় আজ সুগন্ধ উৎসবের রাত্রি। বিভীষণ রাজমহিষী হিসেবে গ্রহন করছেন মন্দাধরীকে। বিয়েয় আমন্ত্রিত রাম-দূত দ্রাবিড় বীর হনুমান। তার শৈর্য্য ও পরাক্রমের কথা ভুবনখ্যাত। দেবব্রত জেনে অবাক হলেন, প্রায় দেবত্বপ্রাপ্ত এ দ্রাবিড় বীর ও ব্রহ্মচারী।

জাহাজে তাকে বিদায় জানাতে এসেছে সৌদ্রক্ষী। তার যে চোখ, সে চোখ সাগরের প্রতাপের মতোই চাতকীর চাহনি। হয়ত সে চোখে ক্রন্দন। দেবব্রত তাকে জড়িয়ে ধরলেন। অদ্ভুত সে মায়া সাগর ক্রোড়া জলরাশি থেকেও ফেনীল।

জাহাজে উঠতে উঠতে দেবব্রত তাকে বললেন,"ভাল থেকো স্বর্ণকঙ্কালে"

নারী আসলেই বড় অসহায়। হঠাৎ করে দেবব্রতের তার মা গাঙ্গোত্রীকেই সঠিক বলে মনে হয়। নারীকে জিততে হবে, যেভাবে হোক; সে পথ বন্ধুর; কিন্তু প্রায় তুচ্ছার্থক প্রানী হিসেবে আর্যাবর্ত শালীনতার অংশ হওয়ার চেয়ে, তাকে জেতার জন্য অচেনা পৃথিবীতে সসীম নারীশক্তির বশবর্তিনী হওয়া সুখকর।

তিন

আবার কবাক্ষ দেশে ফিরে আসি। কবাক্ষ দেশ অনার্য দ্রাবিড়ের দেশ। আরো বিশদভাবে বললে বলা যায়; ধীবরের দেশ। এখানের রাজার নাম ধূষরাজ। তার কন্যা সত্যবতী। তিনি শ্যামলা ও অপুর্বা।গত একমাস ধরে এখানে এসে তাঁবু গেড়ে বসে আছেন একজন। তিনি হয়ত রাজন্য ছিলেন আর্যাবর্তের। তার চুলে সোনালী আভা এবং নীল চোখ তো তাই বলছে। তবে বহুদিনের অনাহার, দেশভ্রমণ ও কঞ্চুকী জটায়, তাকে আর দশজন শুদ্র দ্রাবিড় থেকে আলাদা করা যায় না।

কুর্বাকের সবাই তাকে উন্মাদ বলে চেনে।প্রতিদিন শল্ব পত্রে করে তিনি শ্লোক রচনা করেন,এবং সেটা ধীবররাজের প্রাসাদের সামনে রেখে আসেন।আজ যেমন লিখেছেন,

"তম্বুল পত্র যেমন স্বাদী,এবং মৃগয়া হরিণের মাংস, রোদে ও ভাপে ঝলসানো, তার চেয়ে ঝলসানো উর্বর এই শ্যামল গাত্র।"

রাজ প্রহরীরা তার এই পাগলামীর সাথে অভ্যস্ত। তাই তারা তাকে আর কিছু বলে না।

তবে দেবব্রত এই মুহুর্তে এই উন্মাদের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। সে জেনেছে, তার পিতৃভুমি হস্তিনাপুরের পথের হদিশ এই দ্রাবিড় ভুমিতে একমাত্র এই উন্মাদই জানে।
উন্মাদ মৃত্তিকায় উপবিষ্ট, গভীর মনোযোগে তিনি কিছু লিখছেন।
দেবব্রত খেয়াল করল দুজনের চেহারায় আশ্চর্য মিল। ঠিক এই উন্মাদের নীল চোখ যেন দেবব্রতের চোখে বসানো। জটাধারী সেই চুলেও কৃষ্ণ -লালভ
  আভা।

প্রণাম আর্য্য। আপনি কি হস্তিনাপুরের দিশা আমাকে বলতে পারেন।

এই উন্মাদ যেন কিছুটা বিস্মিত হয়েই দেবব্রতের দিকে তাকালেন।

জানি, পুত্র। কিন্তু তার আগে বল, তুমি কে?
তুমি দাক্ষিণাত্য থেকে আসছ?

-হ্যাঁ আর্য সাগরপার। জাহাজে নেমেছি সেখানে। সেখান থেকে এলাম এই কুর্বর দেশ। আমি গিয়েছিলাম লঙ্কায়।

-লঙ্কায়! সেখানে ত যুদ্ধ হচ্ছে।

-যুদ্ধ থেমে গেছে এখন। এখন সেখানে ছাই। সম্রাট দশানন হত। বিভীষন সিংহাসনে বসেছেন।

-কাপুরুষ সে! আর মুর্খ মর্কট গোত্র? তারা কি করছে?

-তাদের ও ক্ষয়ক্ষতি প্রচুর আর্য্য। কিন্তু অযোধ্যাপতিকে তারা অবতার ঘোষনা করেছে।

-হা হা হা! ইতিহাসে প্রত্যেক বিজয়ীই অবতার পুত্র। এবং অবতার হয় আর্য্য। কখনো কৃষ্ণবর্ণ দ্রাবিড় না। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গতিপথটি মুর্খ বানর গোত্র-দ্রাবিড় নির্নয় করল। যুদ্ধে জিতল আর্য্য। হতাহতের দু পক্ষই দ্রাবিড়।

কৃষ্ণ বর্ণের মানুষেরা সবসময়ই হারে পুত্র।

এসময় জটাজুট এই উন্মাদ দেবব্রতের দিকে তাকালেন। দেবব্রত কখনো যখন কারো দিকে তাকায় ঠিক সেরকম বিনিময় দৃষ্টি।

- তোমার সবিস্তার বল পুত্র। কোত্থেকে এসেছ?

-আমি এসেছি গান্ধর্ব দেশ থেকে। আমার নাম দেবব্রত। দেবব্রত গাঙ্গোত্র। আমি গঙ্গাপুত্র।

ঠিক এ সময়ে,এ কথা শুনে উন্মাত বিস্ময়াভিভূত হলেন,অথবা কোন উর্ণজাল তাকে কিছু বলতে গিয়েও বলতে দিল না। তিনি কি কিছু বলতে চাইছেন? বা কোনো পুরোনো সম্পর্কের স্মৃতি ঝালাই করছেন। কে জানে!

শুধু তার কানে বাজছে, সমুদ্রদেবের প্রবল ফেনীলে হারানো নিক্কনের মত কোন কম্পন।

"আমি দেবব্রত। গঙ্গাপুত্র। দেবব্রত গাঙ্গোত্র।"

এই উন্মাদ তার বৃদ্ধ ঘোড়ার দিকে চললেন।

"চলো আমার সাথে। আমিও হস্তিনাপুর যাব। আর শোন আমি আর্য নই। আর্যত্ব নিষ্ঠুর ও ক্রুর। আমি শুদ্র। তামাটে শুদ্র। আমার নাম শান্তনু।"

শান্তনু এবং দেবব্রত দুজনেই কোনো নতুন ভুমির দিকে যাত্রারম্ভের প্রস্তুতি নিলেন। হয়ত এ যাত্রা দীর্ঘকালীন কোনো ইতিহাস পরম্পরায় আমাদের টেনে নেবে। অথবা নেবে না।

No comments:

Post a Comment