১.
একটা ঘর। দেওয়ালের রঙ
ইন্ডিগো ও স্কাই ব্লু কম্বিনেশনের। দেওয়ালের একদিকে লাগানো খাট, দেড়জন শোয়ার মত।
ঘরটার একদিকে লাইফসাইজ গ্লাস শাটার দেওয়া জানলা। শাটারের ওপাশ থেকেই একচিলতে
ব্যালকনি। বিছানায় একটা মেয়ে ঘুমাচ্ছে। তার বুক পর্যন্ত ঢাকা দেওয়া, গলার কাছটা
ঘেমে উঠেছে। বন্ধ চোখের পাতার নিচে মণিদুটো প্রচণ্ড নড়াচড়া করছে। টিটিটিটিটিটি...
ফোনের সেট করা অ্যালার্ম বাজছে সাইড টেবিলে। মেয়েটার মনে হল তার চোখ খুলল। একটা
সাদা ধোঁয়া ধোঁয়া জায়গা। মেয়েটার মনে হল, সেই সাদা ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে কিছু একটা
তার দিকে ছুটে আসছে। একটা গতির আওয়াজ। কিছু একটা ঝড়ের গতিতে আসলে যেমন হয়।
টিটিটিটিটিটি...একটা আওয়াজ আসছে কোথাও থেকে। মেয়েটা সেই আওয়াজ লক্ষ করে প্রাণপণে
ছুটল। ধক করে চোখ খুলল মেয়েটা। এবার সত্যি করেই। সাইডটেবিল হাতড়ে ফোনটা নিয়ে বেজে
চলা একটানা শব্দটা বন্ধ করল। উঠে বসে মুখটা দুহাতে ঢেকে রাখল, একটু ধাতস্ত হতেই
হয়ত। মেয়েটার নাম দময়ন্তী সেন। ওরফে ড্যামি।ফোনের জান্তব গলা বলে উঠল –SOS ! নিউ সাবজেক্ট অ্যারাইভড।
ড্যামির ছোট্ট কোয়ার্টার। রিসার্চ সেন্টার থেকেই দেওয়া হয়েছে।
একটা রুম, ছোট লিভিং স্পেস সাথে সাইড কিচেন ও বাথরুম। তার ঘর খুব সাজানো নয়।
আসবাবের বাড়বাড়ন্তের প্রয়োজন নেই। একটা বুকশেলফ আছে। আর একটা রাইটিং টেবিল। একটা
সিঙ্গেল সোফা। একটা মিউজিক সিস্টেম ও ল্যাপটপ। এসবের মধ্যে ড্যামির সবচেয়ে প্রিয়
তার টেবিলল্যাম্পটা। ফ্ল্যাটটাকে
অন্ধকারে চুবিয়ে এই টেবিলআলোটা জ্বেলে ডায়রি লেখাটা তার প্রিয় কাজ। তার ছাই রঙের
ডায়রিটা খোলা পড়ে আছে এখন। তার
খোলা পাতায় ঝুঁকে আছে টেবিলল্যাম্পটার গোল কমলা মাথা। ডায়রির পাতার লেখা কিছুটা
এরকম-
মানুষ চেয়েছিল প্রকৃতির
ন্যায় সর্বোচ্চদেবতার মডিফিকেশনকরতে। তারপর সভ্যতা কখন যেন ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গুলি, বোমা, মিসাইল, রক্তক্ষয়, হত্যা, ধর্ষণ ইত্যাদির মাধ্যমে তথাকথিত যুদ্ধের রূপ
এখন বদলে গেছে। সেই অর্থে ক্রাইম রেট কম। এখন একটা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হতেএকটা ছোট
মাইক্রোস্কোপিক জীবই যথেষ্ট। এতদিন পৃথিবীর দূষণ, বায়ুস্তরের ক্ষয়, প্রাকৃতিক
সম্পদের শেষনিঃশ্বাস কোনোকিছুই মানুষকে প্রভাবিত করেনি। একমাত্র মৃত্যুই মানুষকে
প্রকৃত অর্থে বিচলিত করে। একমাত্র মৃত্যুই পারে মানুষকে শুধরে দিতে।
২.
বিছানা ছেড়ে উঠে ফ্রেশ হতে যতটুকু সময়। তারপরেই
ড্যামি পৌঁছে যায় তার ওয়ার্কস্টেশনে। ছোট্ট খুপরিটায় ঢুকে সারা শরীর মুড়ে ফ্যালে
সেফটিশ্যুটে। তার টিমের আর সাতজন তখন তৈরি। লম্বা টেবিলের ওপর শোয়ানো রয়েছে কালো
ব্যাগটা। জিপটা ধীরে ধীরে খোলা হয়। ড্যামি জিজ্ঞাসা করে, “হিস্ট্রি কী
সাবজেক্টের?” একজন মৃতদেহের নাম, বয়স, নিবাস, মৃত্যুর ডিটেইলস দিতে শুরু করে। ড্যামি
ও তার সহকর্মীরা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে দেহটিকে। সারা শরীর মসৃণ, তারুণ্যের
উজ্জ্বলতা এখনও নষ্ট হয়নি । এই রোগ- উইপোকার মত অনাড়ম্বর
কিন্তু ধ্বংসাত্মক। ওপর থেকে কোনো ক্ষত সৃষ্টি করে না। এমনকি মৃত্যুর পর
ময়নাতদন্তেরও দরকার হয় না।
ড্যামি তার পরিবারের এক এবং
অন্তিমজন। তার মা, বাবা ছাড়া পরিবার বলতে কিছুই নেই। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে
প্রথম আলোড়ন আনে নোটবন্দীকরণ এবং তারপরেই নতুন ট্যাক্স বিল চালু হতে তার বাবার ছোট
প্রাইভেট কোম্পানিটা বন্ধ হয়ে যায়। ড্যামির মা তখন একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ে
কর্মরত। ড্যামির পড়াশোনার শেষ বছর চলছিল পাশাপাশি অজানা ভাইরাসে আক্রান্ত হতে থাকা
মানুষের সংখ্যা বাড়ছিল। এর মাঝেই তার ডিগ্রি শেষ হয়। আর ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসে
সারা পৃথিবী। লকডাউনের দেড় মাসের মধ্যে তার মায়ের স্কুল থেকে একটা ফোন আসে । খুব
সুচারুভঙ্গিতে ছাঁটাইয়ের খবরটা দেয় তারা। এরপর দিনে দিনে একটা ঘন
অন্ধকারে ডুবতে থাকে ড্যামির পরিবার। কিছুদিন পর একটা ফোনকল আসে ড্যামির মেডিকেল
কলেজ থেকে।সেখানে ফরেন্সিক সায়েন্সের একটি স্পেশাল টিম গঠন করা হয়েছে বর্তমান এই
ভাইরাস সংক্রান্ত রিসার্চ ওয়ার্কের জন্য। সেই টিমের একজন গবেষক হিসাবে নির্বাচন
করা হয়েছে ড্যামিকে। তার সম্মত হওয়া ছাড়া আর কোনো অপশন ছিল না
হয়ত। একতাড়া কাগজ হাতে এক এসোসিয়েট তার সামনে বসে। ড্যামির দিকে কলম বাড়িয়ে দিয়ে
তার চোখে চোখ রেখে বলে, “মিস সেন, আপনাদের এই টিমকে একটি স্পেশাল পারপাস রিসার্চের
জন্য পাঠানো হচ্ছে এবং সেটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। নির্ধারিত দিন ছাড়া আপনি কারোর
সাথে দেখা করতে পারবেন না বা বাড়িও যেতে পারবেন না। এমনকি আপনার কাজের মেয়াদ
চলাকালীন যদি আপনার কিছু হয়ে যায় তাহলে প্রিয়জনের কাছে আপনার মৃতদেহ পর্যন্ত
পাঠানো যাবে না। এসব ভেবে ও বুঝে কনট্র্যাক্টে সই করবেন। ফারদার কোনো অব্লিগেশনস
অরগ্যানাইজেশন বেয়ার করবে না”। ড্যামির শুধু মনে পড়ে আজ
সকালের এ.টি.এম-র স্টেটমেন্টটার কথা। ৮০৩৩। এটাই শেষ সম্বল। সে
সই করা শুরু করে।এক রবিবার সকালে তাদের ছোট গাড়িটা এইখানে আসে। বিশেষ ভাইরাসটার
নামের পাশে জোড়া হয়েছে বডি ফার্ম রিসার্চ সেন্টার কথাটা। একেবারে শহরের বাইরে
এসেও তাদের গাড়িটা আরও অনেকটা পথ এসেছে। একটা জঙ্গুলে এলাকা- এইখানে তৈরি করা
হয়েছে ড্যামিদের বিশেষ কাজের জায়গা। ২৭ একর জায়গা জুড়ে কাঁটাতারে ঘেরা এই বডি
ফার্ম। ড্যামিদের প্রত্যেকের হাতে তাদের ছোট ছোট ফ্ল্যাটের চাবি তুলে দেওয়া হয়।
৩.
মানুষ মারা যাওয়ার পর থেকে
তার দেহের পচন এবং তা কিভাবে ধীরে ধীরে মাটিতে মিশে যায় এই সব বিষয়ে গবেষণা করা হয়
বডি ফার্মে। বডি ফার্ম রিসার্চ ফরেনসিক অ্যানথ্রোপলজির একটি শাখা। বিশাল
জায়গা জুড়ে বডি ফার্ম তৈরি করা হয়। মৃতদেহগুলি আনার পর খোলা জায়গায় রেখে ধাতব
তারের খাঁচা জাতীয় জিনিস দিয়ে ঘেরা হয়। এছাড়াও কোনো বাক্স বা
তোরঙ্গ, পুরোনো গাড়ির ডিকি ইত্যাদি জায়গায় দেহগুলিকে রাখা হয়। খুন বা যেকোনো
হত্যায় মৃতদেহ সম্ভাব্য যতগুলো জায়গায় থাকতে পারে সেরকম কৃত্রিম সেট আপ বানানো হয়
বডি ডিকম্পোজিশনের জন্য। জলে ডুবিয়ে রাখা লাশগুলো স্টাডি করা ড্যামির
সবচেয়ে অস্বস্তিকর মনে হয়।মৃতদেহ পচনের সাথে সাথে মানবদেহের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য
বদলে যায়। সেই বিষয়েই ফরেনসিক সায়েন্সের গবেষকরা স্টাডি করেন যা দুর্ঘটনা বা
হত্যারহস্য সমাধানে প্রচণ্ড সহায়তা করে। ১৯৮১ সালে অ্যানথ্রোপলজিস্ট ডঃ উইলিয়াম
এম.বাস প্রথম বডি ফার্ম স্থাপন করেন টেনিসিতে- ইউনিভার্সিটি অব টেনিসি
অ্যানথ্রোপলজিক্যাল রিসার্চ ফ্যাসিলিটি। ২.৫ একর জায়গা জুড়ে ছড়িয়েরয়েছে এই ফার্মটি।মানবদেহের ডিকম্পোজিশন পদ্ধতিকে চারটি স্টেজে ভাগ করাহয়-
প্রথম হচ্ছে ফ্রেস স্টেজ, যখন মৃতদেহ সদ্য আনা হয়। দ্বিতীয় ধাপকে বলা হয় ব্লট
স্টেজ। এরপর আসে সবচেয়ে ভয়ংকর ডিকেই স্টেজ যে সময় মৃতদেহ গলে, পচে যেতে শুরু করে।
এরপর শেষ ধাপ- ড্রাই স্টেজ, যখন মৃতদেহ শুকিয়ে যায় এবং ক্রমশ হাড়ের খাঁচা বেরিয়ে
আসে। এইসব ফার্মে সাধারণত এইডস, হেপাটাইটিস ইত্যাদি রোগে
আক্রান্ত বডি ডোনেশন নেওয়া হয় না। কিন্তু ড্যামি যেখানে কাজে যোগ দিয়েছে অর্থাৎ এই
স্পেশাল রিসার্চ ফ্যাসিলিটি ফার্মে শুধুমাত্র বর্তমানে ভাইরাস আক্রান্ত
মৃতদেহগুলিই আসে। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ড্যমি ও তার টিম স্টাডি করে যে এই
মৃতদেহগুলির ডিকম্পোজ পদ্ধতি অন্যান্য মৃত্যুর সাথে কতটা মেলে বা কতভাবে তা পৃথক।
আজকের মৃতদেহ ছিল একজন বছর
পঁচিশের তরুণের। সুঠাম শরীর, তরতাজা অবিন্যস্ত চুল তার কপালে ছড়িয়ে ছিল। ড্যামি
কোনোদিন মৃতুর সামনে দাঁড়াবে ভেবে চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে পড়েনি, মানুষকে মৃত্যুর
ছায়া থেকে বের করে আনার জন্য এই রাস্তায় এসেছিল। কিন্তু সময় ও পরিস্থিতির
ষড়যন্ত্রে সে এখন এমন এক জায়গায় কাজ করছে যেখানে তার ভূমিকা শুরুই হয় মৃত্যুর
পরবর্তী ধাপ থেকে!অজান্তে ঢুকে পড়া এই ভাইরাস যুবকটির দেহে সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং
একুশ দিনের মাথায় তার অঙ্গ- প্রত্যঙ্গরা কাজ করা বন্ধ করে দেয় একে একে। শরীর নষ্ট
হওয়ার সাথে সাথে জলের মধ্যে এই ভাইরাস কতটা কার্যকর থাকছে বা জলবাহিত হলে এই
ভাইরাস ইনফেকশন ছড়াতে কতটা সক্ষম এসব পরীক্ষা করতেই যুবকের দেহকে একটি কৃত্রিম
জলাধারে ডিকম্পোজিশনেরজন্য রাখা হল। দিনের পর দিন এই দেহ পরীক্ষা করে যেতে হবে
ড্যামিকে যতদিন না মাংস খসে সাদা হাড় বেড়িয়ে আসছে। ফিল্ড থেকে
ওয়ার্কস্টেশনে ফেরার রাস্তায় ভাইরাস প্রোকেক্টেড স্পেশাল মাস্কের ভেতর ড্যামির ঘন
প্রশ্বাস কেউ শুনতে পারে না। বুঝতে পারে না। রিসার্চ শ্যুট পরিবর্তন করে,
সারা শরীর স্যানিটাইজ করে সাধারণ পোশাক পড়ে ড্যামি। কোয়ার্টারে ফিরতে ফিরতে আলো
কমে আসে। ছোট্ট ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে
গরমজলে দুধ- কফি মেশানো প্যাকেটটা ছিঁড়ে পুরোটা ঢেলে দিল ড্যামি । সরু চামচ টুং
টুং শব্দে গুলিয়ে দিচ্ছে পানীয়। দূরের গাছগুলো অন্ধকারের সাথে সাথে পোড়া দেশলাইয়ের
মত হয়ে উঠছে। গতকালের বাচ্চাটার কথা মনে পড়ে
ড্যামির।
৪.
সে স্বপ্নে দেখছিল বাচ্চাটাকে। তার চোখদুটো সম্পূর্ণ আর ঠোঁটটা ঈষৎ খোলা।এখানে
আসা ও কাজ করার কিছুদিন পর থেকে ড্যামি এক নতুন ব্যাপার লক্ষ্য করছে।তারমনে
হয় তার নিজের ঘুমের মধ্যে কোনো
অস্বাভাবিকতা আছে।অথবা ঘুম ভাঙার মধ্যে। তার একটা ঘুমের ভেতর যেন আর
একটা ঘুম লুকিয়ে থাকে! তার ঘুম ভাঙে দুবার করে বা দুই ধাপে।গভীর ঘুমের মধ্যে যখন
প্রথমবার তার চোখ খোলে, একটা আবছা, আকারহীন, আলোছায়াময় জায়গায় নিজেকে পায়সে। আর এই স্টেটে কিছু ঘটনার সম্মুখীন হয় যেগুলো আদতে
স্বপ্ন হলেও সেই মুহূর্তে তার কাছে অত্যন্ত জীবন্ত এবং সত্যিকারের বলে মনে হয়। এই
পর্যায়ে সে সমস্ত অনুভূতি বুঝতে পারে অর্থাৎ তার ইন্দ্রিয় প্রচণ্ড সজাগ থাকে।
স্বপ্নের মধ্যে স্বাদ, গন্ধ, আঘাত ইত্যাদি স্পষ্ট অনুভব করে। আসল পৃথিবীর সবকিছু
থেকে সে এই পর্যায়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একমাত্র প্রকৃত পৃথিবীর বিভিন্ন শব্দ তার
কানে আসে এই সময় আর সেই শব্দ ধরেই সে ফিরে আসে প্রতিবার অর্থাৎ তার ঘুম ভাঙে আসলেই।
গতকাল দেখছিল একটা বাচ্চা
মেয়েকে কোলে নিয়ে সে ছুটছে। কেন বা কাদের থেকে পালাচ্ছে সে জানে না। কিছু একটা ভয়
থেকে পালাচ্ছে এটুকু বুঝতে পারছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পড়ে সে বুঝতে পারে মেয়েটা আর
নড়ছে না। তার চোখদুটো খোলা, স্থির; তার ঠোঁট ঈষৎ ফাঁক। এই মুহূর্তে কোথাও থেকে
একটা শব্দ আসতে থাকে। একটা ফোনের রিংটোন। ড্যামির
ঘুমটা ভেঙে যায় সত্যি করেই। তার বাড়ি থেকে ফোন আসছিল। “মাহ”,
ফোনটা তুলে ড্যামি ভেঙে পড়ে। তার মা ওদিক থেকে কিছু জিজ্ঞাসা করছিল তাকে। ড্যামির
চোখে তখনও সেই বাচ্চাটার মুখটা ভাসছিল। তার মা এখন বাড়িতে যে টেবিলের সামনে
বসে ড্যামিকে ফোন করছেন, সেই টেবিলে ওই বাচ্চাটারই একাধিক ছবি আছে!
বিভিন্ন বয়সের।এই দুই প্রস্থ ঘুম ভাঙার অদ্ভুত খেলায় না চেয়েও ড্যামিকে যোগ দিতে
হয় আজকাল। যেন সে নিজের ঘুমের কাছেই বন্দী। প্রথমবারের ঘুম ভাঙা থেকে আসল জেগে
ওঠার কাছে তাকে টেনে আনে কোনো শব্দ। আজকাল তাইফোনের চার্জ, অ্যালার্ম এগুলো সে
ঘুমানোর আগে বার বার চেক করে। ভয় হয়, যদি
সে কোনো শব্দ না পায়?
৫.
ব্যালকনির শাটার টেনে ঘরে
আসেড্যামি। এখন কিছু সোশ্যাল সাইট ছাড়া
বাইরের দুনিয়ায় কি ঘটছেকিছুই জানা হয় না। ফোন হাতে নিয়ে
লগ ইন করতে একটা ভিডিও পপ করে ফোনের
স্ক্রিনে। ভাইরাস আক্রান্ত এক মহিলা একটি লাইভ ভিডিওতে তার দীর্ঘদিন সেলফ
আইসোলেশনে থাকার মুহূর্তগুলো নিয়ে কথা বলছেন। তিনি টানা সাড়ে তিনমাস একা আছেন একটি
ঘরে বা বলা যায় আউটহাউসে।বাড়ির লোক বাইরে থেকে খাবার দিয়ে চলে যাওয়ার সময় তিনি
জানলা দিয়ে তাদের দেখতে পান। প্রচণ্ড যন্ত্রণার সময় কপাল ছুঁয়ে সামান্য স্নেহ
প্রদান করার মত কেউ নেই। এই ৫৮ বছর বয়সে তিনি এক বিচ্ছিন্ন গ্রহের বিষাক্ত জীবের
মতই বেঁচে আছেন, দীর্ঘসময় হয়ে গেছে তবু তার রোগ লক্ষণ যায়নি। এভাবে আর কতদিন? এসব
কথা বলতে বলতেই তার ফোন ক্যামেরা ঘোরালেন। তার ফ্যান থেকে একটি ফাঁস লাগানো কাপড়
ঝুলছে। প্রৌঢ়া ধীরে ধীরে বিছানায় উঠছেন। অন্যান্যদের মত ড্যামিও বুঝতে পারে না কী
করা উচিৎ তার। এক তীব্র অসহায়বোধে সে আক্রান্ত হয়। একটা লাইভ সুইসাইড ভিডিও! এই
ভাইরাস শুধু শরীর বিকল করছে তা নয়, সাথে অনির্দিষ্ট এক একাকীত্বের দিকে থেকে ঠেলে
দিচ্ছে সবাইকে এবং তার থেকে মুক্তি খুঁজতে মানুষ সেই মৃত্যুর দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে।
ড্যামি অসহ্য অবসাদে তার হাতে ধরে থাকা ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে দেয়।তার সামনে ফুটে উঠতে থাকে এই ভাইরাসের পরোক্ষ প্রভাবের কথা। কত মানুষের জীবন
জীবিকা পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ মধ্যবিত্ত শ্রেনী গ্রাসরুট লেভেলে নেমে আসছে।এই পরিস্থিতির মধ্যে এই প্রায় জনহীন, শব্দহীন নিথর মৃতদের ফার্মে থাকতে
থাকতে ড্যামির মনে হয় তারা আসলে মৃত্যুর ভয়াবহতাকে তিলে তিলে বাড়িয়ে তুলছে
এখানে। তবু কিছু করার নেই তার। মৃত্যু এখানে শেষ
কথা নয়।
রাত হয়ে আসে। ড্যামি তার
রেফ্রিজরেটর থেকে একটা স্যান্ডুউইচ বের করে। প্রথম কামড়ের চাপে চুইয়ে আসা সাদা
মেয়োনিজটা দেখে সাদা ম্যাগটসগুলোর কথা মনে পড়ে। মৃতদেহগুলোর চোখ, ঠোঁট ভেদ করে ওরা
বেড়িয়ে আসে ডিকেই স্টেজে। এসব ভাবতে ভাবতে সে খেয়ে চলে।খানিকটা
নির্বিকার।বা বাধ্য হয়ে।
৬.
বিছানায় যেতে আজ নিজের
অজান্তেই ঘুমএসেযায় ড্যামির । ঘুমের মধ্যে একটা
পর্যায়ে তার চোখ খোলে। সে দ্যাখে তার বাবার সাথে সে একটা
জঙ্গলের মধ্যে ঘুরছে। হয়ত এটা একটা রেইনফরেস্ট।সময়ের
চাকা বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল গাছেরা।হাঁটতে হাঁটতে একটা জায়গায় পৌঁছায় সে;এই অংশটায়গাছ
কাটা হচ্ছে। চারপাশে অনেক শ্রমিক মোটা মোটা গাছের শব চিরছে। শয়ে শয়ে মৃত গাছ।
তাদের ডাল পাতা ছড়িয়ে আছে চারপাশে। এক একটা গাছ যেন ধরাশায়ী দানবের মত শুয়ে আছে।
হঠাৎড্যামি দ্যাখে সে একা। তার বাবা কোথাও নেই। শ্রমিকরা এক মনে
গাছ কাটছে- তাদের কুঠারের কোপ, চেইন করাতের আওয়াজে চারপাশ ঝাঁ ঝাঁ করছে।সে
দিশেহারা হয়ে ওঠে খানিকটা। লক্ষ্য করে শ্রমিকদের মধ্যে একজন একজন করে তার দিকে
তাকাচ্ছে, তাদের চোখের ভাষা ভীষণ অচেনা। ড্যামির
দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তাদের মুখ চোখ গা হাত পা সব কেমন গঠন বদলাতে শুরু করে। তাদের চামড়ার ওপর বড় বড় কাঁটাওয়ালা গুটি ফুটে
উঠতে থাকে; সারা শরীর এই গুটিতে ঢেকে যেতে থাকে। তাদের গঠন ল্যাবটেস্টে ধরা পড়া এখনকার ভাইরাসটার মত।
তারা হাতের যন্ত্রপাতি ফেলে এক এক করে কামড় বসায় মৃত গাছেদের দেহে। গাছের গা থেকে
সাদা কষ বেরোয় ভলকে ভলকে।
এক তীব্র আতঙ্কে ড্যামির মনে হয় তার ঘুম ভেঙে গেছে, হয়ত সত্যি করেই এবার।
অন্ধকারে ধাতস্ত হতে বুঝতে পারে সে নরম ভিজে কোনো জায়গায় শুয়ে আছে। হাতড়ে ওঠে ,
ভালো করে এদিক ওদিক দ্যাখে, দেখতে পায় একরাশ মৃত মানুষের মাঝে বসে সে। তার চারপাশে
ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আধপচা শবদেহ। এই অনন্ত অন্ধকারে ড্যামির সাথে তাদের পার্থক্য
মুছে যেতে থাকে। সে কোনো শব্দ খোঁজে, চেষ্টা করে শুনতে কোনো শব্দ যা ধরে সে আসলেই
ঘুম ভেঙে উঠতে পারে, ফিরে আসতে পারে। কিন্তুচারপাশ নিস্তব্ধ। কোনো শব্দ নেই।
ড্যামি উঠে ছুটতে শুরু করে অন্ধকারের মধ্যে।দিশাহীন।
ছোট্টফ্ল্যাটটার খাটেরপাশে আধভাঙা ফোনটার মতই বিছানায় পড়ে থাকে ড্যামির নিথর দেহ।
বেশ অন্যরকম।ভালো লাগলো
ReplyDeleteভাল
ReplyDeleteভালো লাগল দিদি।
ReplyDeleteভালোই লাগল।
ReplyDeleteভালো।
ReplyDelete