বাক্‌ ১৪২ ।। ঋতু বদলের জিনিয়াস কথক– তায়েব সালিহ ।। শুভংকর গুহ



        
অন্ধকার–তারপরে, অন্ধকারআরও গভীর অন্ধকার। 
সেই অন্ধকারকে সংজ্ঞায়িত করেছিল একটি মহাদেশ। একদিকে আলোকোজ্জ্বল ইউরোপ অন্য দিকে অন্ধকারের যথার্থ সংজ্ঞা, আলোর বণিকেরা নিজেদের মহাদেশকে আলোকিত করার জন্য অন্ধকার মহাদেশটিকে হাজার বছর ধরে নির্বিকার লুণ্ঠন করে গেল। বাঙলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথের আফ্রিকা কবিতাটি স্মরণে আসতে পারে। কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই ১৯৩৬ সালে দার্ব্বান-এ মহাত্মা গান্ধিজিকে উৎসর্গ করে কবি কালিদাস নাগ লিখেছিলেন –     
প্রথম দাস-জাহাজের বুকে,
সমুদ্রের তাণ্ডবে মনে পড়েছিল বোধ হয়-
একদিন তুমিই গেছিলে প্রথম কাঠের কাটামারান,
লঙ্ঘন করেছিলে অসীম সাগর।
আজ তোমারই পায়ে বেড়ি, হাতে শিকল,
তবু তার মধ্যেই জাগছে যেন জন্মান্তরের স্মৃতি।
নেচে উঠছ তুমি
নাচিয়ে তুলেছ তুমি, তাঙ্গো নৃত্যে,
শাদা কালোর ভেদ ঘুচিয়ে ;
জাগছে ঘৃণ-প্রীতির যুগ্ম নৃত্য।  

আমরা এরপরে একটি ঘৃণার আখ্যানের সাথে ক্রমগত এগিয়ে যাব। একজন কথক যিনি নিজের গ্রামে ফিরে এসে গোটা একটি মহাদেশের প্রতি প্রতিশোধের কাহিনিকে নিজেই আক্রান্ত করবেন। তার আগেই জেনে নিতে হবে আমাদের আফ্রিকার স্বপ্নভঙ্গের আখ্যানের ইতিহাস। গভীরতম মায়া বাস্তবতা, উত্তর ঔপনিবেশিক ও চূড়ান্ত আধুনিকতাবাদকে একটুও প্রশ্রয়ে না রেখে আমরা এগিয়ে যাই বরং সামান্য জেনে রাখা কিছু তথ্যের দিকে।

গোটা উত্তর আফ্রিকার আখ্যানের খুঁটিনাটির ওপরে আমরা সবেমাত্র আলো ফেলতে শুরু করেছি। দক্ষিণ আফ্রিকার দুইজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন লেখিকা ও লেখক নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত নাদিন গার্দিমার ও জে এম কোয়েৎজি সম্পর্কে আগেই জেনেছি,-দুইজনের লেখা অনেক বেশি ইউরোপ কেন্দ্রিকতায় আচ্ছন্ন। আমদের উদ্দেশ্য থাকবে উত্তর আফ্রিকা জুড়ে ঘৃণার দীর্ঘশ্বাসের মৌনতাকে জেনে নেবার। ইতিমধ্যে চিনুয়া আচিবি, তায়েব সালিহ,  আহলাম মোসতেনঘানেমি, হানড়বা মিনানগুগি থিয়াঙ্গো, আমোস তুতুওয়ালা, সেমবেন ওসমান, নাগিব মাহফুজ সম্পর্কে সামান্য জেনেছি। প্রায় চার বছর ধরে কঠিন পরিশ্রমের ফলে আরবি ভাষার একজন মহৎ লেখক নাগিব মাহফুজ উত্তর আফ্রিকার আখ্যানের জাদুকর তিনি। প্যালেস অব ওয়াক, প্যালেস অব ডিজায়ার এবং সুগার স্ট্রিট তিনটি খণ্ডিত অধ্যায়ে তিনি লিখলেন পনেরশো পাতার দীর্ঘতম “কায়রো ট্রিলজি”। ১৯৮৮ সালে তিনি এই প্রথম আরবি ভাষার লেখক হিসেবে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হলেন। নোবেল বক্তৃতায় তিনি বললেন –“এই সুন্দর ভাষাটির মূর্ছনা এখন আপনারা শুনতে পারবেন”। এই সময়ের বহু আগে থেকেই কায়রো শহরে বামপন্থী মতবাদ  দানা বেঁধে উঠছিল। নাগিব মাহফুজ একজন কট্টর মার্ক্সবাদী। মার্ক্সীয় সাহিত্য সম্পর্কে তিনি তাঁর নানান লেখার মধ্য দিয়ে ব্যক্ত করেছেন। ইজিপ্ট জুড়ে বামপন্থী বাতাস বইছে।

মিশরের লেখক যার জন্ম কায়রো শহরে সোনাল্লা ইব্রাহিম আধুনিক আরবি সাহিত্যের বামপন্থী ঔপন্যাসিক হিসেবে  পরিচিত। তিনি তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে বামপন্থাকে ব্যক্ত করেছেন রিপোর্টাজ ভঙ্গিতে। তাঁর উপন্যাসের প্রধান বিষয় ইউরোপ কি ভাবে একটি শীতল ছায়া সমৃদ্ধ মহাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে লুণ্ঠন করেছে। সোনাল্লা ইব্রাহিমের বিখ্যাত উপন্যাস “অনার” অনেকগুলি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। আপাতত আমরা একটি ধারণা তৈরি করতে চাইছি। সেই ধারণাটির প্রতি ঔপনিবেশিক ঘৃণাকে উগরে দেওয়ার আগে আরবি সাহিত্যের বুনিয়াদটিকে জেনে নিই।  

বিশ্বসাহিত্যে প্রথম কথকের সন্ধান পাই আরবি সাহিত্যে। সহস্র সহস্র রজনী অতিক্রম করে যে কথক আজও আমাদের গল্প শুনিয়ে যাচ্ছে। মধ্যযুগ ধরে যখন পয়ার পদ্য ও কবিতার শাসন চলছে, ঠিক তখন আরবি সাহিত্য স্রোতের বিপরীতে গিয়ে কথকের মাধ্যমে গল্প উপন্যাস রচনা করছে। রাজা রানি পরীদের সাথে দানবের যুদ্ধ তুফান তোলা যৌনতা আর বিশ্বাস অবিশ্বাসের কাহিনি গেঁথে দিল আরবি ভাষার লেখক। স্বাধীনতার লড়াই পরাধীনতার তীব্র গ্লানি এবং অবশ্যই শিকল ছিঁড়ে ফেলার জেদ ও ঘৃণা রূপকথা থেকে নেমে এল নড়কে। সাব অলটার্ন অত্যাচারিত মানুষজন এই সবের মধ্যে রয়েছে গল্প ও কাহিনি যা কি না একটি মহাদেশের ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিতে পারে। আরবি ভাষার লেখকরা আবিস্কার করলেন একটি মহদেশের পরাধীনতার মধ্যেই রয়েছে দীর্ঘশ্বাস এবং ঘিরে আছে গল্প। লিখিত আরব্য উপন্যাস পাওয়া গেছে ১৪ শতকে। তবে উপনিবেশ কায়েম হওয়ার বহু আগেই আরবি ভাষা সাহিত্যে ছড়িয়েছিল নানা গল্প ও উপকথা।

বিশ্বসাহিত্যে একমাত্র আরবি ভাষা সাহিত্যেই কথা এবং উপকথা সর্বাধিক প্রভাব ফেলেছিল। ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে আফ্রিকা নিজের সাহিত্যের সমস্ত উপকরণগুলিকে হারিয়ে যেতে বসেছিল। ১৯৭৬ সালে অক্টোবর মাসে তাসখণ্ডের এক সম্মেলনে ঘানার লেখিকা আম আতা আইদু গভীর দুঃখের সঙ্গে বললেন,-“আমি কি বলব, আমাদের কী আছে ? সাম্রাজ্যবাদের বিষের মতো নিঃশ্বাস আমাদের সব পুড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের আফ্রিকার ভাষা হারিয়ে গেছে। আমরা আমাদের স্বদেশেই চিরনির্বাসিত। আমাদের কোনো প্রত্যাবর্তন নেই। নির্বাসন ও প্রত্যাবর্তনহীনতা ছাড়া তেমন কোনো বিষয় নেই, অন্য কোনো বিষয় থাকতে পারে না। আমাদের অগ্রাধিকার অন্যরকম”।

কঙ্গোর কবি শিকায়া উতামাসি যিনি লিখছিলেন,- “খ্রিষ্ট, আমি থুতু দিই তোমার হর্ষে। সরাসরি বলেছেন, অতীতের  বিস্মৃতি ছাড়া কৃষ্ণাঙ্গদের পক্ষে ক্ষমায় পৌঁছনো সম্ভব নয়”। সেনেগালের বিশিষ্ট কবি দাভিদ দিওপ চমৎকার বলেছেন,- “ঐ যে গাছ বেড়ে ওঠে দিব্য ওখানে, সাদা ফ্যাকাসে শুস্ক ফুলের মাঝে। সেই তো আফ্রিকা, তোমার আফ্রিকা নতুন পল্লবের জন্ম দেয় সে, ধৈর্যে অধ্যাবসায়ে নতুন পল্লবের জন্ম দেয় ধীরে ধীরে তাঁর ফলে সঞ্চারিত হয় স্বাধীনতার তিক্ত স্বাদ”। আর একটি সাক্ষাৎকারে সব থেকে বাস্তব ও সত্যি বলেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার স্বনামধন্য কৃষ্ণাঙ্গ ধর্মযাজক ডেসমণ্ড টুডু-“ঔপনিবেশিকরা যখন আমাদের দেশে এল, তখন তাদের হাতে ছিল বাইবেল আর আমাদের হাতে জমি। ওরা বলল চোখ বন্ধ করো, প্রভুকে ভাবো, আমরা চোখ বন্ধ করলাম। তারপর  চোখ খুলে দেখি আমাদের হাতে বাইবেল আর ওদের হাতে জমি”     

প্রাচীন মিশরের পাথরের ওপরে খোদাই করা লিপি অনুসারে জানতে পারছি, তিনিই ছিলেন প্রজাদের দ্বারা নির্বাচিত প্রথম বাজ পাখিদের রাজা। সিনাই-এর মরুভূমি ওয়াদি মাঘারা-র একটি উপত্যকায় চারশো ফুট উচ্চতার তিনটি পাহাড় কেটে একটি সুন্দর মূর্তি গড়ে তোলা হয়েছিল। এইখানেই উচ্চ অঞ্চলের মিশরের রাজাকে সাদা মুকুট ধারণ করতে দেখা যায়। প্রহরারত বেদুইন ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। রাজাকে সাহায্যকারী সেনাপতি সবসময় তটস্থ। একটু নিজেকে অনুসন্ধানী করে গড়ে তুলতে হলে জানতে হবে, এই প্রকার ভাবনার ও বিভ্রমযুক্ত কল্পনার পাশে এসে বসেছে, গল্প বলিয়ের দল বা কথক। ওরা এই উপত্যকাতেই জমপেশ গল্প শোনানোর কাজ কারবার ফেঁদে বসেছিল। বাজপাখির দল ঠোঁটে করে কুড়িয়ে আনত নানান গল্প, লোককথা, রূপকথা ও উপকথা। সেই সব গল্পগুলির বা রূপকথার বিষয়গুলি ছিল, রাজা রানির মাহাত্ম্য, জাদুকর, শিকার বা ঠগ জচ্চুরি ও জুয়ারিদের কাহিনি। বেশ কয়েক বছর পরে, কথক বা গল্প বলিয়ের দল বাজ পাখিদের সংগ্রহ করা কাহিনি, উপকথা, রূপকথাগুলি সংগ্রহ করে নেমে এসেছিল নিল নদের পারে। মরূদ্যানের জন সমাজের অভ্যন্তরে।    

আমরা এই সূত্রটিকে অবলম্বন করে, ধরে নিতে পারি ইউরোপ থেকে ফিরে এল কথক। আর অনায়াসে বলতে থাকল নিজের কথা রূপকথার আদলে। শুরু করল এই ভাবে,–“ বুঝলেন মশাইরা, অনে-ক দিন পর মানে ঠিক সাত বছর পরে আমি আবার আপনজনের মধ্যে ফিরে এলুম। এতদিন আমি বিলেতে পড়াশুনো করছিলাম। এই সময়ে আমি শিখেছি অনেক কিছুই – অবশ্য সে গপ্পো স্বতন্ত্র। মোদ্দা কথাটি হল আমি ফিরে এলাম। একবুক স্বজন সান্ন্যিধ্যের স্বপ্ন নিয়ে। ফিরে এলুম নিল নদের বাঁকে। আমার সেই ছোট্ট গাঁয়ে। আমার আপনজনের মধ্যে”............     

কয়েক হাজার বছর আগে যে কথকের দল, নিল নদের দুই পার ধরে যে যাত্রা শুরু করেছিল, সেই যাত্রাকে তায়েব সালিহ ঘৃণার মধ্যে দিয়ে উগরে দিলেন কথকের মাধ্যমে মুস্তাফা সাঈদের জীবন কাহিনির মধ্য দিয়ে। পরবর্তীকালে পাঠক, হ্যাঁ মশিয়ে-মহামান্য আপনারা মুস্তাফা সাইদকে মেলাতে চেষ্টা করছিলেন এডওয়ার্ড সাইদের জীবনের কাহিনির সঙ্গে। আসলে দুইটি মহাদেশের সংঘর্ষের কথাই বেজে উঠছে করুণতর ভায়োলিনের মূর্ছনার সঙ্গে। আপাত একটি গ্রামকে বেছে নেওয়া হয়েছে, বাড়িগুলি পড়ে আছে পরিত্যক্ত হয়ে, জনচিহ্নহীন। বিলেত ফেরত কথক, বলে যাচ্ছে আত্মহননের কাহিনি। অথবা দেশান্তরিত হওয়ার এক বেদনাদায়ক আখ্যান। সেখানে যেন বহুদূরবর্তী এক ফোঁটা চিহ্নের মতো ভেসে উঠেছে বিভ্রম। যার গভীরে ছড়িয়ে আছে পরাধীনতার গ্লানি।  

গ্রামের নিসর্গে চাদর পেতেছে খেজুরের ফলন। একটি খণ্ডিত খেজুর গাছের নিচে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে, ডোরাকাটা পায়জামা পড়ে কৃষক বালককে। আচ্ছন্নতা ভেঙ্গে যেতে পারে, একটি গাধার চিৎকারে। গ্রামটি ফিরে আসছে নির্জনতা ভেঙ্গে, নিল নদের প্রবাহ থেকে জল টেনে আনছে জলচক্র। ধরা যাক গ্রামটির নাম ন্যুয়ের বা শুলুক। এখান থেকে গোটা উপন্যাসটিতে শুধু একটিবার টোকায় জানতে পারছি, আর পাঁচটি নামের মতো কথকের নামটি হল এফিন্দে।  

কথকের আত্মকথনের মধ্য দিয়ে উপন্যাসটির সূচনা ঘটলেও আখ্যানের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল মুস্তাফা সাইদ নামে একজন রহস্যময় মানুষ। সাত বছর পরে গ্রামে ফিরে এসে কথক আবিস্কার করল মুস্তাফা সাইদকেগোটা গ্রামবাসীদের চোখে মুস্তাফা সাইদ একজন রহস্যময় চরিত্র। বিস্ময়কর এক অগোছালো অথচ নিজের জীবনের প্রতি একজন বিমর্ষ ফেরারি। মেধাবী ঔপনিবেশিক যন্ত্রণার দ্বারা আক্রান্ত একটি বিভ্রম।   

কথকের আব্বা জানালেন,-‘মুস্তাফা আমাদের গাঁয়ের লোক নয়, বাইরে থেকে এসেছে। বছর পাঁচেক হল আমাদের গাঁয়ে এসে জমি জিরেত কিনে বাড়ি তৈরি করে থিতু হয়েছে। শাদিও করেছে। আমাদেরই গাঁয়ের মাহমুদের মেয়েকে। মুস্তাফা না কি কারোর সাতে পাঁচে থাকে না, নিজের কাজকর্ম নিয়েই সারাদিন ব্যস্ত। ওর সম্পর্কে কেউ বিশেষ কিছু জানে না’ 

সেদিনের মুস্তাফাকে আমি ভুলে গেছিলাম। আমার হঠাৎ মনে পড়ল আগের দিন যারা আমাকে স্বাগত জানাতে এসেছিল, তাদের ভিড়ে দেখা একটা অচেনা মুখের কথা। বয়েস পঞ্চাশ কি হয়নি, মাঝারি গড়ন, এক মাথা চুলে পাক ধরেছে। দাড়ি নেই তবে ছোট্ট গোঁফ আমাদের গাঁয়ের লোকেরা যেমন রাখে তার থেকেও একটু ছোট-বেশ সুদর্শন বলা যায়।  

কেন যে লোকটার সম্পর্কে আমার কৌতূহল হল তা ঠিক বলতে পারব না, তবে আমার বেশ মনে আছে সেদিন যখন সবাই আমাকে স্বাগত জানাতে এসে নানা কথা শুধোচ্ছিল, এই লোকটা তখন একটাও কথা বলে নি।  

দাদু আমাকে তুর্কি আমলের একজন জেলা শাসকের গল্প বলেছিলেন। আমি জানি না ঠিক সেই সময়ে কেন জানি মুস্তাফার কথা মনে পড়ল। ঠিক করলাম দাদুকে ওর কথা জিজ্ঞেস করব। ...দাদুকে জিজ্ঞেস করেও কোনো লাভ হল না। যেটুকু জানা গেল তা প্রায় সবারই জানা।  

দাদুর সঙ্গে আলোচনার দুই দিন পরে একদিন বিকেলের দিকে, কী একটা বই মুখে দিয়ে বসে ছিলাম। ...সদর দরজা খুলে বেরিয়ে দেখি মুস্তাফা দাঁড়িয়ে আছে এক ঝুড়ি কমলালেবু আর ইয়াব্বড়ো একটা তরমুজ হাতে নিয়ে। আমাকে অবাক হতে দেখে বলল,- আপনার ঘুম ভাঙ্গালাম না তো। ভাবলাম আমার খেতের প্রথম ফসল আপনাকে খাওয়ার জন্য দিয়ে যাই, আর ভাবলাম, আপনার সঙ্গে একটু আলাপও হবে। অবশ্য এই ভরদুপুরে কারুর বাড়িতে আসা ঠিক নয়। মাফ করবেন।     

আমার গাঁয়ের মানুষ এত বিনয়ের ধার ধারে না। এই প্রথম মুস্তাফাকে খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ  পেলাম। লোকটাকে বেশ ভালো দেখতে। চওড়া কপাল, চাঁদের মত দুই ভুরুর মধ্যে একটু ফাঁক, মাথায় খাসা কাঁচাপাকা, বৃষস্কন্ধ সুঠাম গড়ন। খাড়া ছুঁচলো হয়ে আসা নাক থেকে কয়েক গুচ্ছ চুল বেরিয়ে আছে। কথা বলতে বলতে ও যখন মুখ তুলে আমার দিকে তাকাচ্ছিল তখন লক্ষ্য করলাম ওর মুখখানায় দৃঢ়তা আর দুর্বলতার এক অদ্ভুত মিশেল। ছোট্ট মুখে প্রশান্তি। বড় বড় স্বপ্নালু চোখ, সব মিলিয়ে বেশ সুশ্রী খুলেছে। আমার সঙ্গে কথা বলছিল আস্তে আস্তে। কিন্তু কথাবার্তায় প্রত্যয়ের ছাপ স্পষ্ট। হাসলে সারা মুখটাতে ছড়িয়ে যায় কমনীয়তা আর যখন একমনে অন্যের কথা শোনে তখন মুখখানায় ফুটে ওঠে দৃঢ়তার ছাপ। হাত দুটো সবল, পেশিবহুল,  সরু ছাপার কালির মতন আঙ্গুল। দুই হাত থেকে দৃষ্টি যখন মুখের উপর এসে থামে তখন মনে হয় যেন পর্বত থেকে উপত্যকায় নেমে এলাম।   

হপ্তাখানেক পরে এমন একটা ঘটনা ঘটল যে আমি একদম তাজ্জব বনে গেলাম। সেদিন মাহজুব আমাকে দুপাত্তর খাওয়ার জন্য ডেকে নিয়ে গেল। আমরা বেশ কয়েক পাত্তর চড়িয়ে যখন মশগুল তখন সেখানে হঠাৎ মুস্তাফা এসে হাজির। গ্রামের কৃষি প্রকল্প নিয়ে মাহজুবের সঙ্গে কী সব দরকারি আলোচনা ছিল। তাকে বসতে বলায় সে প্রথমে ইতস্তত করছিল। তারপর মাহজুবের পীড়াপীড়িতে রাজি হল। লক্ষ্য করলুম মাহজুবের জোরাজুরিতে ও একটু ভুরু কোঁচকাল তারপর সহজ হয়ে আমাদের আড্ডায় বসে পড়ল। .........এখন আর তাকে সাধাসাধি করার দরকার হচ্ছে না। একটা পাত্র শেষ করে আরেকটার জন্য হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। ...পঞ্চম পাত্রটা যখন এলো তখন ও সেটা দুহাতে ধরে সামনে পা ছড়িয়ে গা এলিয়ে দিল। শিবনেত্র হয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর পরিষ্কার সাহেবি উচ্চারণে একটা ইংরাজি কবিতা আবৃত্তি করল। কবিতাটা অনেকদিন পরে একটা সংকলনে পড়েছিলাম। সেটা ছিল প্রথম আফ্রিকার ওপর লেখা কবিতার সংকলন। কবিতাটা এইরকম-

কই সে তো ফিরল না।
যুদ্ধ ফেরত সৈনিকের দলে কেউ আর
তাকে খুঁজে পাবে না
তাকে নিয়ে বন্দর ছাড়বে না কোন জাহাজ
আসবে না কোন ট্রেন
ট্রেঞ্চে, ব্যারিকেড, রণাঙ্গনের কর্দমাক্ত
পথপ্রান্তে
তার লাশ পড়ে আছে, তবুও
উষ্ণ চুম্বনের তরে অধীর, মৃতপ্রায় ওষ্ঠ, অধর।
নিশুতি রাতের রেলগাড়ি ছেড়ে যায়
চারিংক্রস স্টেশন
পড়ে রইল ম্লান আলো আর হাহাকার।
কতদিন কেটে গেল পথ চেয়ে। ফ্ল্যাণ্ডার্সের ললনাদের।  

আবৃত্তি শেষ হল ওর নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এলো একটা দীর্ঘশ্বাস। হাতে পানপাত্তরটা তখনো ধরে রয়েছে। ও তখন হারিয়ে গেছে আপন মনের গহনে কোন অজানা জগতে।

মশায়রা, আমি আপনাদের হলপ করে বলতে পারি যে সেই মুহূর্তে কোন দত্যিদানো যদি আমার সামনে মাটি ফুঁড়ে উঠে মুখ দিয়ে লকলকে আগুনের শিখা বের করত তাহলেও বোধহয় আমি এতটা শঙ্কিত হতাম না। আমি যেন একটা দুস্বপ্নের ঘোরের মধ্যে রয়েছি। আমার চারপাশে এত লোক, এই শুঁড়িখানা কিছুই সত্যি নয়। সব মায়া। নিজের জায়গায় উঠে দাঁড়িয়ে মুস্তাফাকে চিৎকার করে বললুম কী আবোলতাবোল বকছেন ? আমার কথার জবাব না দিয়ে সে উঠে দাঁড়ালো তারপর আমাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল দৃপ্তপদে। একদল গ্রামবাসীর সঙ্গে হৈ হুল্লোড়ে ব্যস্ত থাকা মাহজুব আমাদের লক্ষ্যই করল না।

পরদিন মুস্তাফার ফসলের মাঠে গিয়ে দেখি ও একটা লেবু গাছের গোঁড়ায় মাটি নিড়োচ্ছে। পরণে একটা আধময়লা খাকি হাফপ্যান্ট, গায়ে সস্তা সুতির জামা, মুখে কাদার ছিটে লেগেছে। আমাকে বিনীত অভিবাদন করে বলল - এই লেবু গাছটার কয়েকটা ডালে গন্ধলেবু আর অন্য ডালগুলোয় কমলা লেবু হয়। ইচ্ছে করেই ইংরাজিতে বললুম - ‘বাঃ মজার ব্যাপার তো’।     

আমার কথা শুনে চমকে উঠে বলল,-‘কী বললেন ?’ আমি আবার ইংরেজিতেই বললুম - ‘বাঃ বেশ মজার তো”। আমার উত্তরে ও হো হো করে হেসে উঠল। আমাকে বিদ্রুপ করে বলল-‘মশাই কি অনেকদিন ইংল্যান্ডে থেকে আরবি ভুলে গেলেন’ ? আমি ওকে মনে করিয়ে দেবার চেষ্টা করলুম – ‘কাল রাতে তো বেশ ইংরাজি কবিতা আওড়াচ্ছিলে ও কোনো জবাব না দিয়ে নিজের কাজ করে যেতে থাকল। জবাব না পেয়ে আমার মেজাজটা চড়ে গেল। ধমকে বললুম যা সেজে আছেন তা যে আপনি নন তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।   

তায়েব সালিহ এখান থেকেই নির্মাণ করতে থাকলেন একটি মহা বিভ্রমের আখ্যান। যেখান থেকে শুরু হয় একটি মহাদেশের প্রতি আরেকটি মহাদেশের ঘৃণার অধ্যায়। এরপরে মুস্তাফা সাইদ একের পর এক বিস্ময়কর দরওয়াজা খুলে দিল। যা কি না তার স্বদেশ এবং ইউরোপে থাকাকালীন সময়ের বিচিত্র বুনন, খবু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তুলে ধরতে থাকলেন প্রতিশোধকামী উন্মাদের জীবনের কুহকী বাস্তবতা। আপাত কথার মধ্যে দিয়ে বিস্তৃত হতে থাকল ধারালো ছুড়ির মতো মুস্তাফার মগজের প্রকাশ। খণ্ডিত করে দিতে থাকল কথকের ইউরোপ থেকে ফিরে আসার সমস্ত অহংকার। এরপরে মুস্তাফা সাইদের নিজের কথায় বলে যাওয়া সুদানের খার্তুমের বিশ্ববিদ্যাল্যের গ্রন্থাগারের  চমৎকার বিবরণ,- মুস্তাফা সাইদ বলে যাচ্ছেন গ্রন্থাগারে সংগ্রহের তালিকা। মুস্তাফা সাইদ সরাসরি বিবরণ দিচ্ছেন, গ্রন্থের তালিকা। বিবরণটিকে ধরে নিতে হবে, শুধুমাত্র ঔপনিবেশিক শাসনের কুফল হিসেবে। আসলে গোটা আফ্রিকা জুড়ে এই সংগ্রহের মাধ্যমে ইউরোপের ঔদ্ধত্বেকে কায়েম করতে চেয়েছিল,- 

“কত বিষয়ের ওপরে বই। অর্থনীতি, সাহিত্য, ইতিহাস, প্রাণীবিদ্যা, ভূতত্ব, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা এনসাইক্লোপিডিয়া, ব্রিটানিকা.........গিবন, ম্যাকলে, টয়েনবি। বার্নাড শ’–এর রচনা সংগ্রহ, কিনেস, টউমি, স্মিথ, রবিনসন। ‘দি ইকনমিক্স অফ ইমপারফেক্ট কমপিটিশন’, হবসনের ‘ইমপিরিয়ালিজম’, রবিনসনের ‘অ্যান এসে অন মার্কসিয়ান ইকনমিক্স’সমাজবিদ্যা, নৃতত্ব, মনস্তত্ব। টমাস হার্ডি, টমাস মান, ই জি মুর, টমাস মুর, ভার্জিনিয়া উল্ফ, ভিটগেনস্তাইন, আইনস্টাইন, ব্রিয়ারলি, নামিয়ের। কিছু বইয়ের নাম শুনেছি বাকি বইয়ের নাম শুনি নি, ‘দি জার্নাল অফ গরডন’, ‘গ্যালিভারস ট্র্যাভেলস’ কিপলিং, হাইসম্যান। ‘দি হিস্টরি অফ ফ্রেঞ্চ রেভিলিউশন’ টমাস কার্লাইল, ‘লেকচারস অন ফ্রেঞ্চ রেভোলিউশন’ লর্ড অ্যাকটন। চামড়া বাঁধানো বই, কাগজে বাঁধানো বই, পুরোন ছেঁড়া ফাটা বই, আনকোরা নতুন বই, বিরাট জাবদা বই, তাসের প্যাকেটের মত ছোটো গিল্টি করা বই, বিরাট জাবদা বই, সই করা, উৎসর্গ করা বই। চেয়ারের উপরে বইয়ের গাদা, বাক্সোভর্তি বই, মেঝেতে বই, চারধারে বই। এসব কী নাটুকেপনা ? ও কী বোঝাতে চায় ? ওয়েন, ফোর্ড, ম্যাডক্স ফোর্ড, স্তেফান ঝোয়াইগ, ই জি ব্রাউনি, ল্যাসকি, হ্যাজলিট ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’, রিচার্ডস, দি কোরান, - ‘দি বাইবেল’ ইংরাজি অনুবাদ, গিলবারট মারে, প্লাটো। ‘দি ইকনমিক্স অফ কলোনিয়ালিজম’- মুস্তাফা সাইদ, ‘কলোনিয়ালিজম অ্যাণ্ড মনোপলি’- মুস্তাফা সাইদ, ‘দি রেপ অফ আফ্রিকা’- মুস্তাফা সাইদ, ‘দি ক্রস অ্যান্ড গানপাউডার’- মুস্তাফা সাইদ। ‘প্রস্পেরো অ্যান্ড ক্যালিবান’, ‘টোটেন অ্যান্ড ট্যাবু’ ডাউটি।   

কিন্তু একটাও আরবি ভাষায় লেখা বই নেই।

একটা কবর।
একটা সৌধ।
একটা উন্মাদ কল্পনা।
একটা কয়েদখানা।
একটা দারুণ পরিহাস।
একটা রত্নভাণ্ডার।
‘চিচিং ফাঁক, এসো সবাইকে ভাগ করে দিই ধনরত্ন।

মুস্তাফা সাইদের তার কথার বিবৃত উপাদানের মধ্য দিয়েই প্রমাণ করে দিয়েছিল ১৯৭০–এর পরবর্তী সময় আরবি সাহিত্য খুঁজে পেয়েছিল নয়া আখ্যানের নয়া গলি ঘুপচি। লেখার শরীরকে ক্ষত বিক্ষত করো। বরফের মতন জমাট যন্ত্রণাকে ফালা ফালা করো। গড়ে তোলা আখ্যানকে লবণাক্ত করো। বিস্বাদ করো। নির্গুণ করো। অর্থাৎ মঁতেন –এর সূত্র অনুযায়ী আমাদের ধরে নিতে হবে –“বস্তুর ব্যাখ্যার চেয়েও ব্যাখ্যার ব্যাখ্যা দেওয়া আমাদের এখন বেশি  প্রয়োজন”।    

‘সিজনস্‌ অব মাইগ্রেসন টু দি নর্থ’ উপন্যাসটির কথক এবং মুস্তাফা সাইদের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে আবিস্কৃত  হয়ে যায় ক্রমশ এক কুয়াসার চাদর। দুইটি চরিত্র কখনো এক সাথে মিশে যাচ্ছে, পরস্পরকে বোঝার চেষ্টা করছে। কথক মুস্তাফার খোলের ভিতরে আসল মানুষটিকে যতই নিজের বোধের অভ্যন্তরে বন্দি করতে চাইছে, মুস্তাফা ততই কঠিন হয়ে উঠছে।  ফাঁকি দিচ্ছেএকদিন কথকের দিকে মুস্তাফা এগিয়ে দিল এক তোড়া কাগজ। তোড়াটা খুলতেই বেরিয়ে এল বার্থ সার্টিফিকেট। লেখা রয়েছে ; মুস্তাফা সাইদ, খার্তুম, পিতা-সাইদ ওথকান (প্রয়াত), মাতা-ফতেমা আব্দুস সাদেক। তারপরে বের হয়ে এল একটি সার্টিফিকেট যা লেখা তাই, তবে পাশে  লেখা রয়েছে ‘ছাত্র’। পাসপোর্ট জারি করার তারিখ- ১৯১৬, আর নবীকরণের তারিখ ১৯২৬ লণ্ডনকাগজের তোড়ার মধ্য থেকে আর একটা পাসপোর্ট বেরল। ব্রিটিশ পাসপোর্ট, জারি করার তারিখ ১৯২৯, লণ্ডনএই পাসপোর্টের পাতায় নানা দেশের শিলমোহর ; ফ্রান্স, জার্মানি, চিন, ডেনমার্ক।  কথক উত্তেজনায় কাঁপছিল। মুস্তাফা ছিল নির্বিকার। সিগারেটে টান দিচ্ছিল। অনেকক্ষণ পরে এফিন্দের দিকে তাকিয়ে, মুস্তাফা বলেছিল ,- সে এক লম্বা কাহিনি, তবে সব কথা আপনাকে বলছি না।   

প্রায় দুইটি মহাদেশ যার ভিতরে প্রসারিত, সে তার কথা বলে অনেক যন্ত্রণার সাথে স্বাভাবিক হয়ে এল নিল নদের উচ্ছ্বাসের মতন নয়, অনেকটা মরুভূমির ওপরে বহুকাল আগে বৃষ্টিপাতের পরে থিতিয়ে থাকা বালুর মতো। অন্ধকার সরে যেতে থাকল। উঠে আসতে থাকল চিরায়ত রহস্যের এক চাপা দীর্ঘশ্বাস, উচ্ছৃঙ্খলতার তুফান তোলা বুনে যাওয়া কথার বিন্যাস। শুধুমাত্র পশ্চিমি কতকগুলি ধারণাকে তোল্লাই দিতে গিয়ে আফ্রিকাকে হাজার হাজার বছর ধরে মূল্য চোকাতে হয়েছে। আসলে মুস্তাফা আফ্রিকার এক উচ্ছৃঙ্খল চিহ্ন। যে নিজের ভিতরে তীব্র প্রতিশোধের জাগ্রত বাসনাকে নরখাদকের মতন লালন করে গেছিল। অথচ নিজেকে উপস্থাপিত করেছে একজন যৌনকাতর ইতর হিসেবে। ইউরোপে যেখানেই গেছে, সুন্দরই ললনাকে ছুঁয়েছে সেই মুস্তাফার প্রেমে পাগল হয়ে গেছে। সুন্দরী ললনা অন্য পুরুষের কথা ভুলে গেছে। শরীরের প্রতিটি মোচড়ে ছিল তার তীব্র আকর্ষণ। আর এটাই ছিল মুস্তাফার ফাঁদ।  

আসলে সে চূড়ান্ত ছদ্মবেশী, গভীর রহস্য অর্জন করেছে আফ্রিকা থেকে। ইউরোপীয় নারীদের শরীর থেকে নিতে চাইছিল তীব্র প্রতিশোধ। সমস্ত রক্ষণশীলতাকে ভেঙ্গে দুমরে মুচরে দিতে চাইছিল। মুস্তাফা উন্মাদ হয়ে উঠেছিল। শরীর ছাপিয়ে যৌন রহস্যের সমস্ত দেওয়াল ভেঙ্গে মুহূর্তগুলিকে বদলে দিতে চেয়েছিল ক্রোধে, যুদ্ধক্ষেত্রের এক রণহুংকারে, চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল ইউরোপীয় উন্নাসিকতাকে, লুণ্ঠনের চিরাচরিত প্রথাকে দম্ভ ও আস্ফালনকে। নিছক ওথেলো, ক্যালিবান আর বোকা বুনো কালা আদমির সমস্ত খোলস ভেঙ্গে বেরিয়ে এসে অভিশপ্ত কলোনিয়ালিজমকে থুতু ছেটাতে চাইছিল। কোনো কিছুতেই তার কিছুই এসে যায় না।

কিন্তু শিকার করতে গিয়ে সে নিজেই একসময় শিকার হয়ে গেল। বিমর্ষ, বিষণ্ণ, অস্তিত্বহীন, স্বান্ত্বনাবিহীন এক  শূন্যতা, উদাসীন একটি সময়। লণ্ডনের আদালতে বিচার চলছিল দিনের পর দিন। পাবলিক প্রসিকিউটর, স্যার আর্থার হিগিনস তার সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুস্তাফার ওপরে। কিন্তু মুস্তাফার হাসি পাচ্ছিল। অস্তিত্বই নেই এমন একটি মানুষের সাথে অযথাই হিগিনস কুস্তি বা সংঘর্ষ করে যাচ্ছিল। অথচ এই হিগিনস-ই মুস্তাফাকে অক্সফোর্ডে ক্রিমিনাল ল’ পড়িয়েছিলেন। মুস্তাফার নীরবতা এবং উদাসীনতার মধ্যে আদালতে ফস্টার বিন উপলব্ধি করতে পারছিল, উদ্ভাসিত হচ্ছিল এক গভীর সত্য যা এই আদালত বুঝতে পারছিল না।    

                 আপনিই কি অ্যান হ্যামণ্ডের মৃত্যুর কারণ ?

                 জানি না

                 আর শিলা গ্রীনউড ?

                 জানি না

                 আর ইসাবেলা সেমুর ?

                 আপনি কি জিন মরিসকে হত্যা করেছেন ?

                 হ্যাঁ।

                 এই হত্যা কি ইচ্ছাকৃত?

অ্যান, শিলা, ইসাবেলা প্রমুখ মহিলা ছিল তার শিকার কিন্তু সে ছিল জিন মরিসের শিকার। জিন মরিস তার জীবনটাকে অস্থির করে তোলে। সে জিন মরিসকে হত্যা করে। হত্যা যে এত শিল্পিত হতে পারে, তায়েব সালিহ নিপুণ শিল্পীর টাচে গড়ে তুলেছেন রহস্যময় বিন্যাস।  

‘এই তো আমার জাহাজ প্রিয়তমা ভেসে চলেছে ধ্বংসের কিনারায়। ঝুঁকে পড়ে ওর কপালে চুম্বন করলাম। ছোরার ধারালো ফলাটা ওর বুকের মাঝখানে রাখলাম। ও আমার কোমর বেষ্টন করল তার পা দুটি দিয়ে। আস্তে আস্তে ছোরাটায় চাপ দিতে থাকলাম। মন্থর চোখ মেলল। কী উন্মাদনা চোখে মুখে। দুনিয়ার সর্বোচ্চ সুন্দর হয়ে উঠছিল সে। প্রিয়তম, খুব ধীরে যন্ত্রণাক্লিষ্ট গলায় বলল,-‘ভেবেছিলাম, তুমি কখনই এটা করবে না।‘  

আমার বুক দিয়ে চাপ দিলাম ছোরাটার বাঁটে, গভীরে ঢুকে গেল। সমস্ত শক্তি দিয়ে চেপে রইলাম। কি করুণ ওর আর্তনাদ,-আমার সঙ্গে চলো। আমাকে একা যেতে দিও না’।

পাবলিক প্রসিকিউটারের মাধ্যমে একটু একটু করে একটি নরখাদকের কুৎসিত ভয়ংকর চেহারাটি উদঘাটিত হচ্ছিল। এই নরদানবের জন্যই দুইটি নিস্পাপ মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। নিজের স্ত্রীকে হত্যা করেছে। আরেকটি বিবাহিত মহিলার জীবন ছারখার করে দিয়েছে।

পাবলিক প্রসিকিউটরের সমস্ত যুক্তিকে ফস্টার বিন পেড়ে ফেলছিল যেন। জুরিদের উদ্দেশে যতটা পারা যায় গলার উঁচু আওয়াজ তুলে বলছিলেন,- 

মুস্তাফা সাইদ মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে, লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক পদে বহাল হয়েছিলেন। গড়ে তুলেছিলেন এক বিশিষ্ট প্রতিভাবানের একটি নিখুঁত চিত্রকল্প। শিক্ষিত এবং উদারচেতা মুস্তাফা সাইদ কখনই খুন করতে পারে না। তিনি পাশ্চাত্য সভ্যতার নির্যাসটুকু অনায়াসে আত্তীকৃত করেছেন। কিন্তু তার মনটি ভেঙ্গে গিয়েছে।   

‘মুস্তাফা সাইদ এই মহিলাদের হত্যা করে নি, এদের হত্যা করেছে একটি মারাত্মক ব্যাধির জীবাণু, যে জীবাণুর সংক্রমণ শুরু হয়েছিল হাজার হাজার বছর আগে’।    

চমৎকার প্রতিরোধ। মুস্তাফা সাইদ বারে বারে সত্যটিকে প্রকাশ করতে চাইছিল, প্রকাশ করতে চাইছিল একটি হাজার হাজার বছরের অন্ধকারের মর্ম ব্যথাকে। কিন্তু গোটা ইউরোপ যেন আফ্রিকাকে অস্বীকার করতে চাইছিল। আসলে মুস্তাফা সাইদ দুইটি মহাদেশের সংঘর্ষকে খতম করতে চাইছিল। ইউরোপ বিশ্বাস করে সংঘর্ষের মধ্যেই আছে মুনাফা। কিন্তু হাজার হাজার বছরের ক্লান্তিতে ভেঙ্গে যাচ্ছিল মুস্তাফার শরীর। তার ভীষণ ঘুম পাচ্ছিল। তার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলতে ইচ্ছে করছিল,-    

‘একটা ডাহা মিথ্যে। সাজানো গপ্পো। আমি ওদের হত্যা করেছি। আমি তৃষ্ণার্ত মরুভূমি। আমি ওথেলো নই। আমি একটা মিথ্যা। আপনারা কেন আমাকে ফাঁসির সাজা দিয়ে এই মিথ্যাটাকে খতম করছেন না। এই মুস্তাফা সাইদের কোনো অস্তিত্ব নেই। সে একটি বিভ্রম মাত্র। একটি আগাগোড়া মিথ্যা। আমার একান্ত অনুরোধ, আপনারা হুকুম দিন এই মিথ্যাকে খতম করার’।  
অবশেষে চতুর ফস্টার বিন গোটা মামলাটিকে সুচতুরভাবে ঘুরিয়ে দিতে চাইছিলেন, এলোমেলো জেরার মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীকে খুঁজতে চাইছিলেন। আসলে দুইটি মহাদেশের সংঘর্ষের মধ্যে মুস্তাফা সাইদ একজন গোবেচারা শিকার মাত্র। কি চমৎকার ভাবে কোনো নারীর সাথে যৌন আচরণের আগে সন্ধি করে নিত মুস্তাফা – যেমন ইসাবেলা সেমুরের সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমে মায়াজাল নির্মাণ করেছিল,-
                  এশিয়া না আফ্রিকা মহাদেশীয় –তুমি কোথাকার লোক ?
                  আমি ওথেলো –আরব আফ্রিকান।
                  আরেব্বাস নিল নদ।
                  হ্যাঁ নিল নদ।
                  তার মানে তোমার বাড়ি নিল নদের ধারে ?
প্রায় নিল নদের ওপরেই বলা যায়। কোনো কোনো রাতে যখন ঘুম আসতে চায় না তখন আমি জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে নিল নদের জলের সাথে খেলা করি যতক্ষণ না আমার দুচোখ জুড়ে ঘনিয়ে আসে গভীর ঘুম। ...তোমার নাম ?
ইসাবেলা সেমুর।
তোমার নাম কি?
আমিন, আমিন হাসান।
বিভিন্ন কথোপকথনের মধ্য দিয়ে ক্রমাগত নির্মিত হয়ে যাচ্ছিল চমৎকার এক ধাপ্পাবাজ –ধোঁকাবাজের অস্তিত্বহীন এক অস্তিত্বের সংকট। এই সংকটেই জর্জরিত হয়ে, প্রায় নাশপাতি চিবিয়ে খাওয়ার মতো আনন্দ অনুভূতিতে আদালতে প্রশ্নগুলির উত্তর দিয়ে যাচ্ছিল মুস্তাফা,-
                ১৯২২ সালের অক্টোবর মাস থেকে ১৯২৩ ফেব্রুয়ারি মাস, শুধু এই সময়টুকুতেই আপনি একই সঙ্গে পাঁচজন মহিলার সঙ্গে সহবাস করেছিলেন। এটা কি সত্যি ?
                হ্যাঁ। 
                আর সবাইকে আপনি বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ?
                হ্যাঁ।
                আর প্রত্যেকের সঙ্গে আপনি পরিচিত ছিলেন বিভিন্ন নামে ?
                আপনার নামগুলি ছিল-হাসান, চার্লস, আমিন, মুস্তাফা, রিচার্ড ?
                হ্যাঁ।
                 এতদসত্ত্বেও আপনি ওই একই সময়ে লিখেছেন এবং বক্তৃতা করেছেন অর্থনীতির এমন একটি ধারার যার ভিত্তি হল ভালোবাসা, পরিসংখ্যান বা সংখ্যা নয় ? আচ্ছা এটা কি সত্যি নয় যে আপনার খ্যাতি অর্থনীতিতে মানবতার ভূমিকা রাখার আহ্বান জানানোর ?
                হ্যাঁ।
                              ফস্টার বিন চাইছিলেন যে ভাবেই হোক মুস্তাফাকে ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচাতেই হবে। মুস্তাফাকে যদি খতম করে দেওয়া হয় তাহলে দুইটি মহাদেশের পরস্পরের সংঘর্ষ একেবারেই থেমে যাবে। বরং সাত আট বছরের জন্য কারাদণ্ড দিয়ে সংঘর্ষটিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সংঘর্ষটি জারি থাকলেই ইউরোপের মুনাফা আছে।   
                              এফিন্দে অর্থাৎ কথকের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের দিন মুস্তাফা তাকে সতর্ক করে দিয়েছিল। এফিন্দে বলেছিল, একজন অখ্যাত ইংরেজ কবির ওপরে পি এইচ ডি করে সে তবেই দেশে ফিরেছে। এতে তার দেশে ফিরে সম্মান বেড়েছিল। মুস্তফা তাই শুনে নিষ্ঠুর হাসি হেসে বলেছিল,-- ইংরেজরা এমন করিয়ে নেয় তাতে সুদানের কোনো লাভ হয় না। বরং যদি কৃষিবিজ্ঞানের ওপর গবেষণা করা যেত তাতে অনেক লাভ হত। সুদানে এখন কৃষিবিজ্ঞানীর খুব প্রয়োজন।  
                      ন্যারেটর সুকৌশলে ফিরে আসতে চাইছিল অনুশাসিত আখ্যানের অভ্যন্তরে। কিন্তু মুস্তাফা সুচতুরভাবে তা ভেঙ্গে দিচ্ছিল এফিন্দের ভাবনাকে। একসময় কথক বুঝতে পারল মুস্তাফা তার ইওউরপীয় অর্জিত শিক্ষাকে হাস্যকর করে তুলল। অজান্তেই কথক মুস্তাফার কাছে আত্মসমর্পণ করল। মুস্তাফার কাহিনি তাকে আচ্ছন্ন করে দিল।  
                     মুস্তাফা সাঈদ কথকের কাছে এই বিষয়টি কনফেস করেবাকি আর কিছুই জানা যায় নি। মুস্তাফার মৃত্যুর পরে কথক জানতে পারে বাকিটুকু মুস্তাফার ডায়েরি থেকে। গোটা বিষয়টি আত্মগোপন করে ছিল শেষ রাতের ধূর্ত এক শিয়ালের মতো। এই হত্যাকাণ্ডের পরে মুস্তাফার সাত বছরের জেল হয় লণ্ডনের কয়েদখানায়। শাস্তিপর্বের পরে সে ইউরোপ পরিত্যাগ করে ফিরে আসে সুদানের এই নেইল গ্রামে। খুব সচেতনভাবে গোড়ার দিকে উল্লেখ করেছিলাম ন্যুয়ের বা শুলুক ণামে। 
                              “সিজনস অব মাইগ্রেশন টু দি নর্থ” উপন্যাসটির শুরু এবং সমাপ্তি বলে কিছুই নেই। কিছু অতি গুরুত্বপূর্ণ ও নিখাদ নির্গুণ ঘটনার স্মৃতিচারণ, মাঝে মাঝে কথোপকথন, আগাপাছতলা বিভ্রমে জড়ানো কথক মানে এফিন্দে কোনো কলোনিয়াল বন্দর খুঁজে পাচ্ছে না মুস্তাফার বয়ান অনুযায়ী। ন্যারেটর সুকৌশলে ফিরে আসতে চাইছিল অনুশাসিত আখ্যানের অভ্যন্তরে। কিন্তু মুস্তাফা সুচতুরভাবে তা ভেঙ্গে দিচ্ছিল কথকের ভাবনাকে। একসময় কথক বুঝতে পারল মুস্তাফা তার ইওউরপীয় অর্জিত শিক্ষাকে হাস্যকর করে তুলল। অজান্তেই কথক মুস্তাফার কাছে আত্মসমর্পণ করল। মুস্তাফার কাহিনি তাকে আচ্ছন্ন করে দিল। কথক বারে বারে নিজেকে এবং নিজের ধারণাগুলিকে ভাঙ্গতে চাইছে।
                              কখনো সে মুস্তাফার কাছে আত্মসমর্পণ করছে, কখনো তার মনে হচ্ছে সে নিজেই তার কাহিনিটি শুনে যাচ্ছে। উপন্যাসটিকে দুইটি পর্বে ভাগ করেছেন লেখক, কিন্তু আখ্যানের মধ্যেই তা গোপনে বসবাস করছে, নিবিড়তর মনোযোগের বিচ্যুতি ঘটলেই খেই হারিয়ে ফেলতে হয়। দুইটি অধ্যায়ে উপন্যাসটি বিভক্ত একটি মুস্তাফার মৃত্যুর আগে এবং অন্যটি মৃত্যুর পরে। মৃত্যুর পরের বিবরণের মাধ্যমে কথক জানাচ্ছে মুস্তাফা নিজের স্বদেশ সুদানে ফিরে এসে কেমন জম্পেশ জীবন ফেঁদে বসেছিলইউরোপ থেকে খার্তুমে ফিরে এসে কয়েকদিন ভাঙ্গা মাস্তুলের মতন এই দিক সেই দিক ধাক্কা খাওয়া তারপরে একটি অখ্যাত গ্রামে প্রত্যাবর্তন, অর্থাৎ আগেই বলা হল ন্যুয়ের গ্রামটির নাম। গ্রামের মেয়ে হোসনাকে সে বিবাহ করে, নমনীয় যৌনতা তাকে আনন্দ দেয়। কবজি ডুবিয়ে সে সংসার করতে থাকে, চাষবাসের কাজে যুক্ত থেকে নিজের বিদ্বান ও মেধাবী জীবনের বাইরে আলাদা স্বাদ খুঁজে পায়। সন্তানের পিতা এবং অল্প কয়েকদিন পরে মুস্তাফার মৃত্যু।    
                              জীবিত মুস্তাফা থেকে মৃত মুস্তাফা অনেক বেশি সক্রিয়। গোটা উপন্যাসটিতে কথক অতি চতুরতার সঙ্গে অনুসন্ধান চালিয়ে গেলেও নিজের ফাঁদে নিজেই জড়িয়ে পড়ল। এখানে কথক এফিন্দে এবং মুস্তাফা সাইদ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। অদ্ভুত একটি কাহিনির পরিণতি... বিস্ময়ের গভীরে তলিয়ে যায় দুইটি মহাদেশের নিয়তি।    
             “চিৎ হয়ে হাত পা বাড়িয়ে ভেসে রইলাম কোনোমতে। নদীর বিদ্ধংসি শক্তি আমাকে নিচে টানছে।  স্রোত ঠেলছে দক্ষিণ পাড়ের দিকে। জানি এভাবে আর বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। নদীর শক্তি আমাকে টেনে নেবে গভীরে। জীবন আর মৃত্যুর প্রান্তে দুলতে দুলতে দেখলাম এক ঝাঁক বেলে হাঁস উড়ে যাচ্ছে উত্তর দিকে। এখন শীত না গ্রীষ্ম ? হাঁসগুলি কি এমনি উড়ছে না দেশান্তরিত হচ্ছে ?
             হঠাৎ একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছে হল। এটা ঠিক ইচ্ছে নয়, একটা তীব্র তৃষ্ণা, ক্ষুধা আর সেই সঙ্গে আমি যেন একটা দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠলাম। আকাশটা আবার স্থির হল। নদীর পাড় টাও আর উঠছে নামছে না, কানে আসছে পাম্পসেটের ফট্ ফট্ শব্দ, শরীরে আবার অনুভব করছি জলের শৈত্য। মনের ওপর থেকে কুয়াসার আস্তরণ সরে গেল, নদীর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা নির্মিত হয়ে গেল। জলে ভেসে রয়েছি অথচ আমি জলের শরিক নই।   
             আমি একটা সিদ্ধান্ত নিচ্ছি, আমি বেছে নিলাম জীবন। আমি বেঁচে থাকব কারণ কিছু মানুষ এখনো রয়ে গেছে যাদের সঙ্গে আমি যতদিন সম্ভব থাকতে চাই আর আমার এখনও অনেক কাজ রয়ে গেছে। জীবনের কোনো অর্থ আছে কি না সে ব্যাপারে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। ...আমি বেঁচে থাকব জোর বুদ্ধি খাটিয়ে। প্রাণপণে হাত পা ছুঁড়ে শরীরটা জলের ওপরে ভাসিয়ে তুললাম। তখনো যেটুকু শক্তি অবশিষ্ট ছিল তার সবটুকু উজাড় করে চিৎকার করলাম- বাঁচাও... বাঁচাও’’ 
         দেশান্তরিত-কথাটির অন্তরালে গভীর ক্ষত, ঔপনিবেশিক যন্ত্রণার এক মহাদলিল “সিজনস্ অব মাইগ্রেসন টু দি নর্থ”। প্রায় শেষের দিকে নিরুপায় হয়ে দেখে যেতে হয়, কথকের অসহায় আত্মসমর্পণ,-   
‘চাবি ঘোরালাম, সহজেই দরজাটা খুলে গেল। নাকে লাগল স্যাঁতসেঁতে গন্ধ –পুরনো স্মৃতির যেনএই গন্ধ আমার চেনা, চন্দন আর ধূপের গন্ধ। দেওয়াল হাতড়াতে হাতড়াতে ঘরে ঢুকলাম। হাতে লাগল জানলার সার্সি। জানলাটা খুলে দিলাম হাট করে। একটা একটা করে আরও দুটো জানলা খুলে দিলাম। একটু আলো আসার বদলে ঘরটা যেন আরও অন্ধকারে, আলোর বিস্ফোরণ হল। আর তার মধ্যে দেখলাম একটা মুখের ভ্রুকুটি। মুখটা খুব চেনা কিন্তু মনে পড়ছে না কোথায় দেখেছি। ওই তো ! আমার প্রতিপক্ষ মুস্তাফা সাইদ। একবুক ঘৃণা নিয়ে মুখটার দিকে এগিয়ে গেলাম। মুখটা আমার সামনে পরিস্কার হয়ে উঠল। একটু একটু করে ছবিটা বড় হতে লাগল, দেখতে পেলুম গলা, ঘার, বুক, হাত, পা, শরীর,-তারপর দেখি নিজেরই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি এটা তো মুস্তাফা সাইদ নয় - আমি নিজেরই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভ্রুকুটি করছি’।     
ন্যারেটর বা কথক উপন্যাসে যাকে মাত্র একবার লেখক এফিন্দে নামে পাঠকের অগোচরে টোকা দিয়ে গেছেন, অবশেষে তার পরিণতি তার ব্যক্তিত্বকে অপহরণ করে নিল তারই বিবৃত আখ্যান, মুস্তাফা সাঈদ নামে তারই স্বদেশের সুদানের একটি বিশিষ্ট চরিত্র। উত্তর আফ্রিকার অনেক বিশিষ্ট সমালোচক তাঁদের লেখার মধ্যে ইঙ্গিত করেছেন আসলে মুস্তাফা সাইদের চরিত্রর মধ্যে এডোয়ার্ড সাঈদের চরিত্রের ছায়া আছে। সেই প্রসঙ্গের জন্য আরও বিস্তৃত অন্য আখ্যান দাবি করছে। তায়েব সালিহ-র স্বীকারোক্তিটি এমনই ছিল,-       
‘’মুস্তাফা সাইদ কোনো বিচ্ছিন্ন মানুষ নয়, শুধু উপন্যাসটি রচনার স্বার্থে মানুষটিকে বিচ্ছিন্ন করতে হয়েছিল। আসলে উত্তর আফ্রিকা জুড়ে ঔপনিবেশিক শাসনটি বিভ্রম এবং মিথ্যায় রূপান্তরিত হয়েছিল। জানতাম, মুস্তাফা সাঈদ একজন চতুর, পণ্ডিত, ধপ্পাবাজ ও ধোঁকাবাজ। মনে হয়, বারে বারে, সে এক অস্তিত্বহীন অস্তিত্ব, এক জাগ্রত মিথ্যা-যে সভ্যতা এবং সংস্কৃতিটি নিজের নয়, তা বহন করতে গিয়েই তার কপালে জুটেছিল ঘৃণা এবং বেদনা।‘’
         উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সালে বেরুটে। আরবি ভাষায়। বিশ্বসাহিত্যে উপন্যাসটি এক তীক্ষ্ণ ধ্রুপদী  সৃষ্টি হিসেবে স্বীকৃতি পেল। উচ্ছসিত হয়ে লায়লা লালামি নিউ ইয়র্ক রিভিউ বুকস্ কলামে লিখলেন –‘অনুবাদক হিসেবে নিজেকে সুখী জীবনের অংশীদার মনে হচ্ছে। উপন্যাসটি উপন্যাসের চাইতেও অনেক বড় কিছু। একটি মহাদেশের দলিল’।  
                              তায়েব সালিহ ১২ জুলাই ১৯২৮ সালে আল দাব্বার কাছে, কারমাকোল গ্রামে এক অতি ক্ষুদ্র চাষি ও ধর্মীয় শিক্ষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পিতৃদেব গ্রামবাসীদের পবিত্র কুরআন পাঠ করে শোনাতেন। ধর্মীয় উপদেশ দিতেন। এই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হয়েও তায়েব সালিহ পরের দিকে কার্ল মার্কসের প্রকৃত অনুরাগী হয়ে ওঠেন। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে বুঝতে চেষ্টা করেছিলেন, উপনিবেশ শাসনের খতমের পরেও শাসককে নিয়ন্ত্রণ না করলে, পরবর্তীকালে শাসক স্বৈরাচারী হয়ে যায়। এমনকি তার অবজারভেশন ও দৃষ্টি থেকে এটাও এড়িয়ে যায় নি বামপন্থী একনায়কতন্ত্রকে যারা রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে উৎখাত করেছে তারাও পরবর্তীকালে কদর্য লুম্পেন স্বৈরাচারী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। জড়িয়ে গেছে আকণ্ঠ দুর্নীতির সাথে। সাধারণ মানুষ সেখানে বোকা বনে গেছে। এই বাস্তব অভিজ্ঞতা বেদনার সাথে চাক্ষুষ করে যাচ্ছি। বলার অপেক্ষা রাখে না। সমগ্র উত্তর আফ্রিকা লেখককে এই আধুনিক স্বৈরাচার সম্পর্কে বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা দিয়েছে।  
                              ঠিক করেছিলেন একজন আদর্শ চাষি হয়েই কৃষি কাজে মনোনিবেশ করবেন। টানা প্রায় দশ বছর লণ্ডনের আরবি ভাষার দৈনিক আলমাজালনা–র সাপ্তাহিক কলম লিখতেন। এ ছাড়া বিবিসি-র আরবি ভাষা বিভাগের বার্তা প্রধান পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন। দোহা, কাতার, তথ্য বিভাগেও প্রধান পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। প্যারিসে দশ বছর ইউনেস্কোর প্রতিনিধি হিসেবে আরবের রাষ্ট্রগুলিতে কাজ করেছেন। তায়েবের লেখার বিষয় বস্তু ছিল সুদানের প্রান্তিক গ্রাম ও গ্রামবাসীদের জনজীবন। মানব জীবনের জটিলতা তাঁকে আগাপাশতলা পশ্চিমি বিরোধী করে তুলেছিল। ‘দি ওয়েডিং অব জেন’ লেখকের আরেকটি বিখ্যাত রচনা। এই রচনাটির নাট্যরূপ বেশ জনপ্রিয় হয়। কুয়েতের চলচ্চিত্রকার খালিদ সিদ্দিকি ১৯৭০ সালে ‘দি ওয়েডিং অব জেন’-এর চলচ্চিত্রে রুপদান করেন। কান চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়। “এক মূঠো খেজুর” তায়েব সালিহর একটি বিশ্ববিখ্যাত ছোটোগল্প। আবেদল করিম মিরযানি লণ্ডনের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ওমদুরমান, মনে করে তায়েব সালিহ-র সাহিত্য রচনা সুদানের জাতীয় সম্পদ। ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ , বিশ্ব সাহিত্যের জিনিয়াস কথক ঋতু বদলের মরশুমের জন্য পা বাড়িয়ে দেন অনন্ত যাত্রার দিকে।  
                      বিখ্যাত সমালোচক হেনরি জেমস বলেছিলেন,-‘ তায়েব সালিহ ঔপনিবেশিক যন্ত্রণার একজন রক্তাক্ত অংশীদার’নিজেকে অন্তরালে নিয়ে, প্রকৃতপক্ষে একটি ছায়ামানবে রূপান্তরিত করেছিলেন। যত দিন যাচ্ছে উপন্যাসটির খ্যাতি আরও বিস্তৃত হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে এমন খুবই কম উপন্যাস আছে, যেটি উপন্যাসের গণ্ডি ছাড়িয়ে একটি মহাদেশের চিহ্ন হয়ে গেছে।    
                              আমিও পাঠক হিসেবে মুস্তাফার ফাঁদে অজান্তেই জড়িয়ে গিয়ে বেরিয়ে আসার অনেক চেষ্টা করলাম। কিন্ত আজ থেকে দশ বছর আগে পড়ে ফেলা এই চমৎকার উপন্যাসটির ফাঁদে পড়ে খুঁজে পাচ্ছিলাম এক অনন্য স্বাদ। কিন্তু সেই স্বাদ নিতে নিতে ক্রমশ জড়িয়ে পড়লাম অনন্ত ফাঁদের গভীরে, বিভ্রম ও আত্মপক্ষ বলে কিছুই নেই, আসলে কল্পিত বা বাস্তব সেই সব মহান চরিত্রগুলি ইতিহাস ও প্রাকৃতিক উপদানে জর্জরিত। আমরা আমাদের কলোনিয়াল ভাবনাগুলিকে এখনও আধুনিক স্তরে পৌঁছে দিতে পারি নি। সাহিত্য রচনার কোনো দেশকালের ব্যবধান থাকে না। এই বিশ্বকে যদি মহাকাশের ব্যাপ্তির কাছে ছোটো আয়তনের গ্রাম মনে করা হয়, তাহলে নিজেদের আখ্যানকে লবণাক্ত করে তুলতে হবে, করে তুলতে হবে বিস্বাদ।
                      ‘সিজনস্ অব মাইগ্রেসন টু দি নর্থ’ উপন্যাসটি আমার ভাবনার দরজাগুলিকে চূড়ান্ত আঘাত করে ভেঙ্গে  টুকরো টুকরো করে দিল। আখ্যানের অভ্যন্তরে প্রবল ভাবে জেগে থাকা কাহিনির আদলকে গুরুত্বহীন করে তুলল। উপন্যাসটি পড়ার পরে আমি এক স্বাধীনতা অর্জন করলাম, অর্থাৎ আমার লেখার সঙ্গেও যুক্ত হল ঔপনিবেশিক বিভ্রম ও যন্ত্রণা নামে এক জটিল চেতনা। আমার ব্যক্তিগত অভিমত “সিজনস্ অব মাইগ্রেসন টু দি নর্থ” উপন্যাসটি উত্তর ঔপনিবেশিক উপন্যাসের ভুবনে এক চূড়ান্ত আধুনিক দলিল।
             সমকালীন প্রজন্মের কথাকারদের এই উপন্যাসের নিবিড় পাঠ অত্যন্ত জরুরি।
            ________________________________________________________________

            কৃতজ্ঞতা স্বীকার
রবিন ক্রসওয়েল
লায়লা লালামি  
মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
দমদম জংশন – বৈদ্যনাথ মিশ্র

তথ্যসূত্র
প্রাচীন মিশর        শ্যামলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
মাহজুব জামাল      অবিচ্যুয়ারি –তায়েব সালিহ
                   গার্ডিয়ান লণ্ডন। ২০ ফেব্রুয়ারি ২০০৯
আফ্রিকার সাহিত্য
সংকলন –          সম্পাদনা বিষ্ণু বসু
অনুবাদক            সিন্দবাদ

                


        
            
            



  



                  


9 comments:

  1. মুগ্ধ, স্তব্ধ।
    অনুজের প্রণাম নিও দাদা।
    এ এক অবিস্মরণীয় কাজ হয়ে রইল।
    বাকরহিত হয়ে গেছি পড়ে।
    (অনিন্দিতা গুপ্ত রায়)

    ReplyDelete
  2. তোমাদের পড়ার অভিজ্ঞতা আমাকে মুগ্ধ করে।

    ReplyDelete
  3. অসাধারণ!মুগ্ধ হলাম।প্রতিটি স্তবকে চমৎকার তথ্য পেলাম।আরও কয়েকবার পড়তে চাই।
    ভালো থাকুন।প্রণাম নেবেন। 🙏

    ReplyDelete
  4. অসাধারণ!মুগ্ধ হলাম।প্রতিটি স্তবকে চমৎকার তথ্য পেলাম।আরও কয়েকবার পড়তে চাই।
    ভালো থাকুন।প্রণাম নেবেন। 🙏

    ReplyDelete
  5. জা তি স্ম র31 May 2020 at 21:40

    অদ্ভূত বিস্ময় জাগালো এই লেখা। একটা ঘোরের মধ্যে থাকলাম

    ReplyDelete
  6. কৌশিক জোয়ারদার31 May 2020 at 21:46

    একটি উপন্যাসের আলোচনা নিজেই এমন মহাকাব্যিক হতে পারে! সাহিত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা আর ভালোবাসা না থাকলে এটা সম্ভব নয়।

    ReplyDelete
  7. খুবই ভালো আলোচনা। উপন্যাসটার প্রতি আগ্রহ বেড়ে গেল...
    -অলোকপর্ণা

    ReplyDelete
  8. অসামান্য বিশ্লেষণ

    ReplyDelete
  9. সমসময়কে অনুভব করলাম এই লেখায়

    ReplyDelete