বাক্‌ ১৪২ ।। সরোজ দরবার ।। ফ্রিডম অফ লাইং




লেখাটা যখন শেষ হল, ভোর হয় হয়। চোখে অল্প অল্প জ্বালা; কিন্তু তেমন ক্লান্ত লাগছে না মিত্রার। প্রতিবার লেখা শেষ করে যেরকমটা লাগে, তার কাছাকাছি কোনও তুলনীয় অনুভূতি সে নিজেই খুঁজে পায় না।
পায় না বলা ভুল। বরং সে-কথা মনে পড়ে এই আলো ফোটা ভোরে তার হাসিই পেল। গা-টা একটু শিরশির করল; সাগ্নিকের সঙ্গে প্রেমটা যখন জমে এসেছে, তখনই তারা শরীরী ঘনিষ্ঠতায় পৌঁছেছিল; রেডিয়োর কাঁটা যেমন ঘুরে পরের স্টেশনে যায়। কেউ-ই বিয়ের চিন্তা-ফিন্তা করেনি। সাগ্নিকের মেস দুপুরে ফাঁকা-ই থাকত। সেই একলা ঘন দুপুরে তারা একে অন্যতে মিশে যেত। সেই প্রথমবার, শরীরের কোষে কোষে, প্রতি রক্তকণায় যে অদ্ভুত তৃপ্তি পেয়েছিল মিত্রা, তার ঝোঁকেই, ওই সময়টা ঘন ঘন মিলিত হচ্ছিলতারপর একদিন তো ফের রেডিয়োর কাঁটা ঘুরে গেল। এখন কোথায় সাগ্নিক! কোথায় অর্ঘ্যর সঙ্গে তার বিয়ে! ডিভোর্স! সে-সব সাত কাণ্ড রামায়ণ; তবু যখনই লেখা শেষ করে, তখনই সে যেন সেই প্রথম কি দ্বিতীয়বারের অনুভূতি ফিরে ফিরে পায়। বোর্হেসের কবিতায় সেই ঘুমন্ত নায়িকাকে যেমন কুমারী মনে হত, লেখা শেষ করে মিত্রারও নিজেকে সেই প্রথমবারের অনুভূতিতে আচ্ছন্ন কিশোরী মনে হয়। কখনও সাগ্নিককে মনে পড়ে; কখনও পড়ে না। আজ, মনে পড়ল।
যাইহোক, সাত-পাঁচ ভাবার বিশেষ সময় নেই। হাজার হলেও, রাত জাগার ক্লান্তি তো আছে। তাড়াতাড়ি একটু চা করে সে জানলার পাশে এসে বসে। তার ঘাড় উঁচু ল্যাপটপটাও আপাতত ঝিমোচ্ছে। বেচারা জানেও না, কাল রাতে ওর মধ্যে ঢুকে পড়েছে দু’জন অদ্ভুত চরিত্র। তাদের গুণ এই যে, তারা কখনও মিথ্যা বলে না। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে, তাদের সেখানে সত্যি বলে কিছু নেই।
যেমন ধরা যাক, তাদের একজন বলল, আমাদের এখানে গাছে পাতা নেই। সাধারণভাবে মনে হবে, লোকটা হয় উন্মাদ নয় জেনেবুঝে মিথ্যে বলছে। কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে, লোকটা সত্যি কথা-ই বলছে। কারণ, তারা যেখানে থাকে, সেখানে সমস্ত বনভূমি কেউ যেন স্লেটে তুলি বুলিয়ে মুছে দিয়েছে। ঘাসের জঙ্গলকেই সেখানে নাম দেওয়া হয়েছে বনভূমি। ঘাস-ই সেখানে গাছ। যদিও গাছের কথা সেখানকার লোকেরা প্রায় ভুলেই গিয়েছে। এবার ঘাসের পাতাকে কি আর গাছের পাতার মতো ধরা যায়! সুতরাং, যদি কেউ বলে থাকেন যে, আমাদের এখানে গাছে পাতা নেই, তবে তিনি যে মিথ্যে বলছেন, এ-কথা জোর দিয়ে বলা যায় না।
স্লেটে, দেখা যায়, সব মুছলেও কোনার দিকে একটু-না-একটু পেনসিলের সাদা ঠিক থেকে যাবেই। এইখানে, এই চরিত্র দু’টির দেশে, সেভাবেই একটা গাছ তবু থেকে গিয়েছিল। সে অবশ্য বাইরে কোথাও নয়, একজন একলা মহিলার ঘরে। উঠোনে বলা ভালোসাধারণ গাছ মোটের উপর কাষ্ঠল তার গুঁড়ি। মহিলা গাছটিকে লালপেড়ে একখানা শাড়ি পরিয়ে রাখতেনগাছের বুকে সিঁদুরের ফোঁটা। দুপুর-সন্ধ্যায় সেই গাছে তিনি ধূপ-প্রদীপ দেন। এখন, এই গাছ তো জানিয়েই দিচ্ছে, গাছের পাতা কেমন হয়। গাছ কেমন দেখতে। ঘাস নয়, এই গাছেরই থাকার কথা ছিল এ-দেশেকিন্তু যেখানে গাছের ধারণা মুছেই দেওয়া হয়েছে, সেখানে একখানা গাছ-ও বেঁচে থাকা মানে পথে কাঁটা জেগে থাকা
এতেই হয়েছে চরিত্র দু’টির মুশকিল। তারা তো আবার কখনও মিথ্যা বলে না। ফলে, এই গাছটিকে কেটে ফেলেই এখন তাদের সত্যিরক্ষা করতে হবেএদিকে, এই গাছ আবার, মহিলার কল্যাণে স্বয়ং ঈশ্বর হয়ে বসে আছে। এখন ঈশ্বরের গায়ে হাত দেওয়া কীভাবে সম্ভব! তা-ও মানুষের ভাবাবেগে আঘাত না-করে! চরিত্র দু’টি এভাবেই পড়েছে মহা ফাঁপরে।
কিন্তু ল্যাপটপ এসবের কিছু জানে না। সে রাতভর অন থেকে এখন ঘুমিয়ে পড়েছে। মিত্রাকে যদিও বেরোতে হবে। পেট চালানোর জন্য যা কিছু কাজ করতে হয়, তা তো করতেই হবে। ল্যাপটপটার গায়ে আলতো করে হাত বুলিয়ে মিত্রা ভাবে, তারা যেন দুটো আলাদা পৃথিবী। এক পৃথিবী যখন জেগে থাকবে, আর-একজন তো তখন ঘুমিয়েই থাকে। অথচ, লোকে বলে পৃথিবী নাকি একটাইজেনেবুঝেই লোকে এই মিথ্যা কথাটা বলে আসছে, বহুকাল ধরে

২.

অফিসে ঢুকতেই সুদীপা বলল, হাজার টাকা বের কর। মিত্রা চোখ কপালে তুলে বলে, পকেটমার নাকি তুই? সকাল সকাল টাকা মারছিস? সুদীপা জানায়, অফিসে বস একটা নতুন ট্রাস্ট খুলেছে, নাম ‘বস কেয়ারস’। দিনকয় আগে এক সিকিওরিটি গার্ডের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, তাকে অর্থসাহায্য করা হবে। কিন্তু, কথা হল এমপ্লয়িজ রিলিফ ফান্ড তো আগেই ছিল। তাহলে আবার নতুন ট্রাস্ট কেন? কে-ই বা তা প্রস্তাব করল? কেনই বা করল? পুরনোটায় কী এমন সমস্যা হল, যে নতুন ট্রাস্ট খুলতে হল? প্রশ্ন শুনে সুদীপা মুখ বেঁকিয়ে বলে, কেন, পুরনো পিরিত থাকতেও লোকে নতুনের কাছে ঘুরঘুর করে না? কথাটা মজা করে না তাকে খোঁচা দিয়ে, ভালো বুঝল না সে। পার্স খুলে হাজার টাকা বের করে দিয়ে সে বলে, তা ভালো। এমপ্লয়ি দেবে চাঁদা, বস করবে কেয়ার। যা, এবার নিয়ে বিদেয় হ দিকি। যেতে যেতেও সুদীপা বলে, পুরনো পিরিত কেসটা কিন্তু ভুলো না।
অর্থাৎ, কথাটা তাকে খোঁচা দিয়েই বলা। কারণ, সত্যি বলতে, অরিন্দমের সঙ্গে তাকে ইদানীং ঘনঘনই দেখা যাচ্ছে। অফিসফেরত সন্ধেবেলা, কোনও একটা কফিশপে বসে একটু চা কি একপ্লেট ঘুগনি খাওয়া— সে বড়ো কথা নয়। কথা এই যে, একটা অভ্যেস তৈরি হয়ে যাওয়া; মিত্রা জানে, এই অভ্যেসই একদিন একটা পরিণতি চেয়ে বসবে। তখন আবার আর-এক কেলো; কেননা এই একলা পৃথিবীটা সে এখনই ছাড়তে চায় না। যত একাই সে হোক না কেন, একার-ও একরকম জোর আছে।
এই জোরটা সে তার লেখায় ওই মহিলাকেও দিয়েছে। তার গোটা দেশে এখন ঘাস-ই গাছ। শুধু সে একা একখানা সত্যি গাছকে সত্যি করেই পুজো করে চলেছে। লোকমুখে সেইসব শুনে একদিন মিথ্যে-না-বলা দ্বিতীয় চরিত্রটি তার ঘরে এল। সে একটু রগচটা প্রকৃতির। গাছের দিকে আঙুল তুলে সে মহিলাকে বলল, শুনুন, আমরা তো আর এসবকে গাছ বলে গণ্য করছি না। সারা দেশ মেনে নিয়েছে ঘাসকে এখন, একা আপনি দেশের বিরুদ্ধাচরণ করছেন কেন?
মহিলা, এত শক্ত কথা বুঝলেন না ভালো করে। গাছের তলাতেই মাথা ঠেকিয়ে বললেন, ইনিই এঁকে রক্ষা করবেন।
লোকটা আবার এই কথাটা বুঝল না; সে যে মাথামোটা তা সে খুব ভালোই জানে। কিন্তু ক্ষমতাবলে এই দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা যখন হয়েছে, তখন নিজের বোকামি ধরা পড়ে গেলে চলবে কেন? অতএব সে যেটা ভালো পারে, সেটাই করল। ধমক দিয়ে বলল, সাতদিন সময় দিলাম। আপনার দেবতাকে বলুন বিদায় নিতে। নইলে আমাদের হাতে করাত কিন্তু তোলা থাকল।
কথাটা চাউর হতেই ঢিঢি পড়ল; লোকজন দু’-ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একদল বলল, গাছ এককালে ছিল তো ছিল; সময় বদলেছে; এখন আর নেই; এই সত্যিটুকু মেনে নিতে সমস্যা কোথায়? গাছের থেকেও ভাবনা করার মতো অনেক বড়ো-বড়ো ব্যাপার আছে। আর-একদল বলল, কিন্তু কেউ যদি কাউকে ঈশ্বরজ্ঞানে পুজো করে, আমরা তাকে কেটে ফেলতে পারি কি?
তখন প্রশ্ন উঠল, ঈশ্বর কে? সাধারণভাবে, সে-দেশের ঈশ্বরের দিকে ফিরে তাকানো হল। দিনের আলোর মতো স্পষ্ট, যে, ঈশ্বরের অধিষ্ঠান মুদ্রায়। মুদ্রার তো এক হাত থেকে আর-এক হাতে ঘুরে বেড়ানোর কথা ফলত, ঈশ্বর তো কারও বাপের সম্পত্তি নয়, যে, একজনের ঘরেই হাঁটু মুড়ে বসে থাকবে।
কিন্তু এরও একটা প্রতিযুক্তি সামনে এল। কথা হল, মুদ্রা তো সব মানুষের কাছে নেই-ই বলতে গেলেদেশের কিছুমাত্র মানুষ মুদ্রা দেখতে পায়তাদের ঘরের সিন্দুকেই মুদ্রা থাকে। তাহলে ঈশ্বর তো সেই কারও কারও ঘরে হাঁটু মুড়ে বসেই আছে; লোকে আর কতকাল আকাশের দিকে হাত তুলে কাল্পনিক ঈশ্বরকে পুজো দেবে! তাই, কেউ কেউ যদি তার নিজের বিশ্বাসমতো একটা ঈশ্বর স্থাপন করে নেয়, তাকে কি দোষ দেওয়া যাবে? তার বিশ্বাসকে কি করাত দিয়ে কেটে ফেলা উচিত হবে?
করাতের কথাটাই করকরিয়ে ছড়িয়ে পড়ল। দেশের একটা বড়ো অংশ বলল, না না, এ ঠিক নয়। এরপর তো ঈশ্বরকে প্রণাম করলে, কবে ফরমান হবে, করাত দিয়ে হাত কেটে নেওয়া হোকএরকম আবার হয় নাকি!
এসব শুনেটুনে, তখন প্রথম চরিত্র সেই রগচটা-মাথামোটাকে ডেকে পাঠাল। বলল, কী দরকার তোর হামবড়াগিরি ফলানোর! এ নিয়ে তুই আর একটা কথাও বলবি না। যা করার আমি করব।
সেদিনই তিনি জনতার সামনে এলেন; তখন একটু রাত হয়েছে মানুষের স্নায়ু দিনের ক্লান্তিতে ঝিমিয়ে এসেছে; খানিকটা উৎকণ্ঠাও আছে। তার ভিতরেই উদাত্ত কণ্ঠে লোকটা ঘোষণা করল, সে যদ্দিন আছে, কেউ কারও বিশ্বাস করাত দিয়ে কাটতে পারবে না। সে নিজে সকলকে রক্ষার দায়িত্ব নিচ্ছে
সেই শুনে মহিলা আবার গাছকে প্রণাম করল। বলল, তুমিই তোমাকে রক্ষা করো। আর, বাকি লোকজন বলল, এই লোকটার কথা শুনলে? একই তো রাজ্যপাট! তবু কত আলাদা! সব মানুষ সমান হয় না। যদিও সকলেই মানুষ
মিত্রা জানে, মানুষ এই একটা কথা জেনেবুঝেই কেমন সত্যি বলে। মানুষ, মানুষ হয়েও আলাদা। এমনকি এক মানুষও কতরকম ভাবে আলাদা।
সেদিন অফিসের পর কফিশপে বসে অরিন্দমকে সে বলে, আচ্ছা আমার সঙ্গে বসে থাকতে তোমার এখন এত ভালোলাগছে বলছ, এই তুমিই একদিন বদলে যাবে না তো? অরিন্দম কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, যেতেই পারিহু নোজ? মিত্রা মাথা নাড়ে। সত্যিই তো কে বলতে পারে! সে এ-ও জানে যে, অরিন্দম তার কাছে কিছু চায় না। শরীর-টরীর কোনও ব্যাপার নয়। হলেও হয়, না-হলেও হয়। তারা দু’জনেই এনাফ ম্যাচিওরডফলে ওই নিয়ে মাথা ঘামানোর এত মানে হয় না। তাহলে কী থেকে যায়? কেন এই অভ্যেসটাকে চলতে দিতে এত ভালোলাগছে তাদের? আলগোছে এই প্রশ্নটাই সে করবে যখন ভাবছে, তখন অরিন্দমই বরং প্রশ্ন করে, কিন্তু আমার বদলে যাওয়া নিয়ে তুমি এত ভাবছ কেন? তুমি তো নিজেই বলো, তুমি বদলাবে না। একাই থাকবে!

৩.

অরিন্দমের বলা কথাগুলো মনে পড়তে একা-একাই হেসে ওঠে মিত্রা; সব ছেলেগুলোই এক লেভেলের মাথামোটা; যা বলা হয়, তার অর্ধেকও বোঝে না। একা থাকার একটা জোর আছে ঠিকই, কিন্তু সত্যিই কেউ একা থাকে না। যে একা থাকে, সে-ও কিছু একটার জোরেই একা থাকে। এটা অবলম্বন থাকে
যেমন ওই মহিলাকে সে থাকতে দিয়েছিল। গাছের জোরেই তো সে একা ছিল। সারা দেশের ঘাসের ধারণার বাইরে, সে একা গাছকেই পুজো করত; কারণ, তার একটা আস্ত গাছ ছিল। গাছের প্রতি অটুট বিশ্বাস ছিল।
সেই বিশ্বাসই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। ভয় ধরিয়ে দেয়নি। তা ছাড়া প্রথম লোকটার আশ্বাস দেওয়ার পর সবকিছু বেশ থেমেই গিয়েছিল। অথবা, যেমন চলার তেমন-ই চলছিল। লোকে খাচ্ছে, দাচ্ছে, বেঁচে আছে। আবার শোরোগোল পড়ল, যখন ঘাসের জঙ্গলের একটা দিকে গুঁড়িগুঁড়ি পোকা লাগল। বেশ খানিকটা জঙ্গল দিনকয়েকের মধ্যে শুকিয়ে লাল হয়ে গেল। প্রমাদ গুনলেন জনগণ; এটুকু ঘাসের রাজত্ব, তা-ও যদি শুকিয়ে যায়, তবে চলবে কেমন করে!
সকলে গিয়ে দরবার করল সেই প্রথম লোকটার কাছে। কেননা তাকেই অপেক্ষাকৃত সহনশীল মনে হত তাদের। সে শুনে চিন্তান্বিত হয়ে পড়ল। তারপর নিজে গিয়ে ঘুরে দেখল শুকনো ঘাসের জঙ্গলের চারপাশ।
তার সঙ্গে আরও কিছু লোক ছিল। তাদের ডেকে বললেন, এখুনি যেন একটা লক্ষ্মণরেখা টেনে দেওয়া হয়, যাতে এই পোকা আর ছড়িয়ে না পড়ে। আর, যেন খুঁজে দেখা হয়, পোকা আসছে কোথা থেকে।
দিন দুই পর তার লোকেরা এসে খবর দিল, পোকাগুলো এসেছে ওই মহিলার গাছ থেকেই। সে-কথা সবিস্তারে জানানো হল জনতাকে। বাড়তি উদ্যোগ নিয়ে শুনে সকলেই হতবাক! যে গাছ, নিজেই ঈশ্বর, তাতে পোকা হল কী করে! সবথেকে উত্তেজিত হল সেই লোকগুলো, যারা বলেছিল, গোটা দেশ যখন ঘাস মেনে নিয়েছে, তখন গাছের পুজো বন্ধ করাই উচিততারা এবার গলার শির ফুলিয়ে বলল, কী বলেছিলাম কিনা! এ নিজেও মরবে, আমাদেরও মারবে। আজ একটা ঘাসের জঙ্গল শুকিয়েছে, কাল আরও ক-টা যায় তার ঠিক নেই। পোকা নয় লক্ষণরেখায় মরবে, কিন্তু এই টাইপের লোক থেকে গেলে, দেশে বিপদ বাড়তেই থাকবে। পোকার মতোই একে খতম করা দরকার
সবথেকে অবাক হল মহিলা নিজে। সে গাছের গোড়ায় রোজ মাথা ঠেকাত। কিন্তু কবে যে গাছের ডালে পোকা লেগেছে, দেখতেই পায়নি। তার বিশ্বাস যেন নিমেষে টলে গেল। আর সে ভীষণ একা হয়ে গেল সেই মুহূর্তে। তার আর ওঠার ক্ষমতা অবধি থাকল না।
মাথামোটা চরিত্রটা ঠিক সেই সময় প্রথম লোকটাকে গিয়ে বলল, আমি যখন গিয়ে দেখেছিলাম, গাছে তো পোকা ছিল না। দেখলে, তখনই কেটে ফেলতাম। তাহলে আর ঘাসের জঙ্গলটা শুকোত না। শুনে প্রথম লোকটা বলল, তা একটা ঘাসের জঙ্গল শুকিয়েছে তো কী আর এমন হয়েছে! মাথামোটা অবাক হয়ে তাকায়! গোটা দেশে বলতে গেলে এই ঘাসের জঙ্গলটুকুই সম্বল। তারও একটা অংশ শুকিয়ে গেল, অথচ বলছে, কী আর এমন হয়েছে! প্রথম লোকটা তখন তাকে বলে, শোনো, তোমার কাজ সত্যিরক্ষা করাকারণ, তুমি তো জানো, আমরা কেউ কখনও মিথ্যা বলি না। কোনও কারণে আমাদের কোনও কথা যদি মিথ্যা হয়ে ওঠে, তবে যে কারণে সে মিথ্যা, সেই কারণটিকে যে কোনও মূল্যে সরিয়ে দেওয়া উচিত নয় কি! তুমি যখন গিয়েছিলে তখন পোকা ছিল না। পরে হয়েছে, ব্যস। এর বেশি ভেবো না। ভাবো যে, এতদিনে ওই গাছটা তুমি উপড়ে ফেলতে পারবে। আর কেউ তোমায় কিছু বলবে না। আমরা যে বলেছিলাম, গাছের পাতা নেই, তা-ও প্রমাণ হয়ে যাবে। লোকে এ-ও জানবে, আমরা সত্যিই কোনও মিথ্যা বলি না।
মাথামোটা ঢিপ করে এবার প্রণাম করে ফ্যালে প্রথম লোকটাকে। সে জানে, কোনও বিশেষ ঘটনা ঘটলেই লোকটা তার মতো মাথামোটাকেও তুমি সম্বোধন করে। সে বলে, তবে আদেশ করো এবার।
আদেশ হয়, এই ঘটনায় এবার যবনিকা পড়ুক। অবশ্য মানুষের ভাবাবেগে যেন আঘাত না লাগে।
অর্থাৎ, মানুষ যা চাইছে, তা-ই করতে হবেমানুষ কী চাইছে? খতম করা হোক। খতম, খতম, খতম... আওড়াতে আওড়াতে মাথায় রক্ত চড়ে যায় রগচটার। সেদিন আকাশ লাল করে সূর্য ডুবছে। যেন আকাশের বুকে কেউ খুন হয়েছে। রগচটা আর দলবল সন্ধের মুখে গিয়ে পৌঁছায় মহিলার বাড়ি। কোনও একটা কারণে এলাকায় সেদিন ইলেকট্রিক নেই। কোনও বাড়িতে আলো জ্বলছে না। ক্রমশ ঘন হতে থাকা অন্ধকারে শুধু বড়ো-বড়ো মশালের আলো জ্বলে ওঠে সেই মহিলার উঠোনে। সারা দেশ অপেক্ষা করছে; শ্বাসরুদ্ধ প্রায়; কী হয় কী হয়! রগচটা সটান ঘরে ঢুকে মহিলাকে বলে, আদেশ আছে, বাইরে চলো। বিচার বসবে। যে কাজ তুমি করেছ, দেশকে যে বিপদের মধ্যে ফেলেছ, জনতা তার শাস্তি দেবে। দেশের থেকে বড়ো আর কেউ-কিছু হতে পারে না।
মহিলা ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকায়। সে তখনও বুঝতে পারে না, কী করে তার এত বিশ্বাসের গাছের ডালে এত পোকা হল! পোকাগুলো কি সত্যি! গাছের ভিতরেই তারা থাকত এতদিন! নাকি সেদিনই কেউ এনে ছেড়ে দিয়ে গেছে! তার এতদিনের বিশ্বাসই বা কোন পোকায় এমন করে খেল! সে কিছুতেই বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না।
মহিলা উঠছে না দেখে রগচটা তার দলের লোকেদের বলল, তোলো তো একে। বাঁধো গাছের সঙ্গে। কথামতো তাই-ই করা হল; মহিলাকে ভালো করে বাঁধা হল গাছের সঙ্গে। তখনও তার মুখে কথা নেই।
রগচটা ভাবে, মানুষ বলছে একে খতম করো। কেমন করে করতে হবে, তা তো কেউ বলেনি। উপায়টা সে ঠিক করবে। নিজের হাতে সে কেরোসিনের জারটা তুলে নিয়ে ছিটিয়ে দিতে দিতে গাছের চারিদিকে পাক খায়। মহিলার চারদিকেও। ছ-বার ঘোরার পর মহিলা প্রথম কথা বলে ওঠেঅবাক হয় রগচটা। এরপরেও কথা বলার ক্ষমতা আছে! যদি থাকেই তবে আগে বলেনি কেন! আগে প্রতিরোধ করল না কেন? এমনিতেই সে মাথামোটা। বেশিরভাগ কথা মাথায় ঢোকে না। মহিলার এই আচরণে এবার হতভম্ব হয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়ে। মহিলা তখন বলে, আর ঘুরো না। আর একবারও না। আমাকে তোমার মারার ইচ্ছে থাকলে মারো। গাছকেও মারো। আমার ঈশ্বরের যদি বাঁচার ইচ্ছে থাকে, সে নিজেই নিজেকে বাঁচাবে। আমি এখনও তাকেই বিশ্বাস করি।
রাগে দাঁত কিড়মিড় করে ওঠে রগচটা। এখনও বিশ্বাস! সেই গাছ আর গাছ! নিকুচি করেছে আজ গাছ আর বিশ্বাসের! দূর থেকে একটা মশাল এনে সে ছুড়ে দেয় সেই গাছের দিকে।
পরদিন সকালে লোকে দেখে একটা কালো পোড়া কাঠামোর মতো কিছু একটা পড়ে আছে সেই গাছের জায়গায়তা মানুষ, না গাছ, না ঈশ্বরের— তারা তা জানে না। বুঝতেও পারে না।
কী এমন ছিল সেই গাছে, যাকে বিশ্বাস করে একটা মানুষ একা-একা পুড়ে খাক হয়ে যেতে পারে! গাছটার জন্য, মহিলার জন্য এবার খানিকটা শোক এসে জড়ো হয় জনগণের মনে। লোকে বলে, শোক ভালো। শোক থেকে শ্লোকের জন্ম হয়। যে-জন বিশ্বাসে পুড়ে যায়, সে তো যায়-ই; কিন্তু বিশ্বাস পোড়ে না। মৃতের জন্য শোক থাকলে বিশ্বাস আবার একদিন বেঁচে ওঠে। হয়তো ওই মহিলা ভেবেছিল, এ-দেশে এভাবেই আবার ফিরে আসবে গাছের ধারণা।
কিন্তু ফিরবেই কিনা, সে-কথা নির্দিষ্ট করে এখনই কেউ জানে না। অকুস্থলে জড়ো হওয়া লোকেরা দেখেছিল, চারিদিকে কেবল ছাই উড়ছে। তার কিছু কিছু এসে পড়ছে তাদের মুখে-চোখে, পোশাকে। তার ভিতর দাঁড়িয়ে তারা শুধু বুঝে নিতে চাইছিল, ঠিক কীসের জোরে মানুষ একা-একা এমন খাক হয়ে যেতে পারে!
সত্যি বলতে, অরিন্দমও সেই সন্ধেয় খুব করে এটাই বুঝে নিতে চাইছিল। বুঝতে দেয়নি মিত্রা। কথার জবাব না-দিয়ে উঠে পড়েছিল এমনটা নয় যে, অরিন্দমের সঙ্গ সে পছন্দ করে না। মিত্রা স্পষ্ট জানে না, তবে নিজের মন হাতড়ালে অরিন্দমের জন্য ভালোবাসার দু’-একটা নুড়ি-পাথর হয়তো কুড়িয়েও পেত। তার চোখে ফুটে উঠছিল সেই ভাবনার ঝিলিক; পড়তে পেরেছিল অরিন্দম। কিন্তু মিত্রা এ-ও জানে, অভ্যেস একটা পোকা; যতবার সে থিতু হতে চেয়েছে, ততবার কে যেন এই পোকা ছেড়ে দিয়ে চলে গ্যাছে তার জীবনে। বাকিটা তার একা-একা পুড়ে যাওয়ার গল্প।
কিন্তু এ-কথা অরিন্দমের মতো কাঁচা ছেলে বুঝলে তো! সে পিছু পিছু আসতে থাকে। আসে এবং আসে; মিত্রার ঘরে, এই সোফাটায় একটু আগেও সে বসেছিল। ঋজু, টানটান; বলছিল, তুমি জানো আমি চাইলে ঠিক কী করতে পারি। মিত্রা কথা বলে না। চেনা মানুষও সময়ে সময়ে কত আলাদা হয়ে যায়। এ যেন অর্ঘ্য কি সাগ্নিক কথা বলছে; কিংবা কেউ নয়, স্রেফ এক ক্ষমতাময় মানুষ; যে তার হক বুঝে নিতে চাইছেঅরিন্দমের এহেন ব্যবহারে খানিকটা অবাক হয়ে তাই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল মিত্রাঅরিন্দম তখনই আচমকা উঠে পড়ে। সামনে দাঁড়ানো মিত্রার দু’-হাত নিজের শক্ত হাতে তুলে নেয় তারপর তাকে ঠেলতে ঠেলতে দেওয়ালের গায়ে ঠেসে দিয়ে, তার চোখে চোখ রেখে বলে, বলো, আমি বদলে গেলে তোমার কী? তুমি কি বদলাবে আমার জন্যে?
মিত্রা সেই প্রথম উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে। সামনে অরিন্দমের হাতের ব্যারিকেড। মুহূর্তের দুর্বলতা ঝড় হয়ে উঠবে; ভাসিয়ে দেবে সবকিছু; তারপর সেই অভ্যেসের পোকা; একা-একা সেই পুনর্বার খাক হয়ে ওঠার নিয়তি। পলকেই চোখের ভাষা লুকিয়ে ফ্যালে সে। তারপর বলে, কেন বদলাব অরিন্দম? আমি কি তোমাকে ভালোবাসি নাকি!

2 comments:

  1. অর্ঘ্য দত্ত31 May 2020 at 04:49

    ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংকিউ দাদা।

      Delete