এক কবি তাঁর প্রেমিকার
জন্য লিখেছিলেন,—
'প্রতিটা মানুষ এ জীবনে তার / মৃত্যুর আগে
মৃত্যুকে দেখে ফ্যালে একবার ।' যে মেয়েটির সম্পর্কে এ কথা
লিখেছিলেন তিনি, তার সঙ্গে শেষ অবধি সম্পর্কটা গড়ায়নি । মেয়েটি
বুঝেছিল, এরকম ধরণের পুরুষের সঙ্গে আর যাই হোক 'সম্পর্ক' ব্যাপারটা মানানসই হয় না । তাই সে ভালবাসতে
গিয়েও বাসেনি । তো যাই হোক, মেয়েটি নিজের সিদ্ধান্তে যখন অন্য
একজন পুরুষকে বিয়ে করে সবে সংসার শুরু করেছে, সেই কবি-পুরুষটির বিরুদ্ধে তখন আমাদের দেশে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে । তাঁর
বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি তাঁর লেখা ও ভাবনার মধ্যে দিয়ে
রাষ্ট্র সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করছেন । যে রাষ্ট্র '৪৭ সালে
স্বাধীনতা পেয়ে গেছে, পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গণতান্ত্রিক
শাসনব্যবস্থার পরিকাঠামোতে, সেই শাসনব্যবস্থাকে ঐ কবি আক্রমণ
করেছেন তাঁর সাহিত্য দিয়ে । সুতরাং, আদালতে মামলা তোলা হয়
তাঁর বইপত্র নিয়ে, লেখালিখি নিয়ে । এমনকী রাষ্ট্র সম্পর্কে
সে আর কখনও কোনও প্রশ্ন করবে না, এই মর্মে তাঁকে দিয়ে মুচলেখা
লিখিয়ে নেওয়া হয় । প্রথমে ব্যক্তিগত বণ্ডে সইসাবুদ করে তিনি জামিনে মুক্তি পান কলকাতা
হাইকোর্ট থেকে । পরে তিনি চলে যান উত্তরবঙ্গে । সেখানে তিনি নকশালদের কার্যকলাপের সঙ্গে
যুক্ত হন । কিছুদিন পরে টের পান, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রবিরোধিতা
উভয়েই ভুল পথে হাঁটছে । তারপর, নকশালদের সঙ্গও তিনি ত্যাগ
করেন এবং শেষপর্যন্ত তিনি কোথায় যে গেলেন, আমরা কেউই তা জানি
না । ততদিনে তাঁর প্রেমিকাটিও একবাচ্চার মা হয়েছে । ফুলের মতো শিশু, ভরা সংসার, স্বপ্নপূরণ, —প্রাপ্তি শেষ । কিন্তু কবিতার ঐ পংক্তি দুটি মেয়েটির মধ্যে থেকে কী যেন
একটা চিরকালের জন্য কেড়ে নিয়ে গিয়েছিল, যার জন্য সমস্ত জীবন
তার নিজেকে অসহায় লাগত ।
২০১২ সালের অগাস্ট
মাস, আমার মাসতুতো দাদা সেই বছর খুন হয়েছিল । এক দুপুরবেলায় খেতে বসেছি,
দাদার মৃত্যুর খবর এল শিলচর থেকে । খুনি তাঁর পরিচিত কেউ হবে,
সে বুঝতে পারেনি । পুকুরের জলে নেমে স্নান করতে করতে জলের মধ্যে ঠেসে
ধরা হয়েছিল তাঁর মাথা । বুদবুদ উঠেছিল কিছুক্ষণ, তারপর এলিয়ে
পড়েছিল তার দেহ জলের গভীরে । জলপাইগুড়ির একই কলেজ থেকে আমি আর আমার দাদা ইঞ্জিনিয়ারিং
নিয়ে পাশ করেছি । অসমে রাস্তার সরকারি প্রোজক্টে দাদা কাজ করছিল অনেকদিন ধরে,
তবু তাঁকে খুন হতে হয় । ন্যায়ের মূল্য দিতে হয় প্রাণ দিয়ে । পৃথিবীতে
যাবতীয় ন্যায়ের মূল্যই মানুষকে দিতে হয়েছে জীবনের বিনিময়ে । যিশুখ্রীষ্ট, গ্যালিলিও, সক্রেটিস, —এঁরা কি ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেননি ? রাষ্ট্র বা কোনও
বৃহত্তর গোষ্ঠী এঁদের যুগ যুগ ধরে হত্যা করেছে নিজেদের স্বার্থ কায়েম রাখার জন্য ।
সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কখনও মানুষকে সরাসরি মারে না, এতে রাষ্ট্রের
বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ ওঠে । কিন্তু পুঁজিবাদী রাষ্ট্র, ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিকল্পিত গণহত্যা ঘটায় । যেমনটা ঘটিয়েছে সিরিয়া
সহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে, কিংবা ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়াতে
। সাধারণভাবে রাষ্ট্র মানুষকে মারে পিষে ফেলার মাধ্যমে, মারে
পরিস্থিতি উদ্বিগ্ন করে দিয়ে । একজন ব্যক্তি, যিনি আদতে নিজের
মধ্যে বিপ্লবী, রাষ্ট্র সেই ব্যক্তির জাতীয়তাবোধকে রাষ্ট্রবিরোধিতায়
পর্যবসিত করে । এর ফলে রাষ্ট্র, দেশের সমস্ত মানুষের নৈতিক
সমর্থন পায় সেই ব্যক্তিকে মেরে ফেলার জন্য ।
এই সমীকরণ শুধু ব্যক্তির
সঙ্গে রাষ্ট্রেরই নয়,
ব্যক্তি বনাম ব্যক্তির ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য । একটা মন আরেকটা মনের
সঙ্গে চিরজীবন আলোচনা ও পারস্পরিকতায় মেতে থাকবে, বিতর্কে
জীবিত থাকবে, তবেই না শরীর-যৌবন-কামনা-বাসনার অতল থেকে উঠে আসবে সেই শাশ্বত উপলব্ধি,
যার জন্য দু'টো মানুষ একসঙ্গে আছে,
ছিন্ন হয়ে যায়নি । সত্যের গভীরে সত্য আছে, তারও গভীরে মানুষের ব্যক্তিগত অবস্থান । প্রেমের ক্ষেত্রে টোকা পড়ে সেই
অবস্থানের দরজায় । ফ্রয়েড রমা রল্যাঁকে একটি চিঠিতে একবার লিখেছিলেন, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই কিছু মানুষের চিকিৎসা করতে চাইতেন না তাদের ব্যক্তিগত
জীবনের কথা ভেবে, কেননা তারা সুস্থ হলেই আবার গিয়ে দাঁড়াবে
তাদের নিজ নিজ জীবনের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির মধ্যে । কেউ-বা
রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা ফাঁসিকাঠে ঝুলবেন । কেউ-বা অভাবের তাড়নায়
কম মজুরির কাজে যোগ দেবেন অথবা দেহ বেচবেন ।
পৃথিবীতে যাঁরা বিরাট
ব্যক্তিত্ব, তাঁরা প্রত্যেকেই তাদের নিজের
চোখে নিজের সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে জগতের ঘৃণা ও সংকল্পগুলোকে লক্ষ করেছেন । সেই কারণে,
প্রতিবার মানুষকে ভেঙে, জাতিকে টুকরো করে
শাসন করা একটা নৈতিক পদ্ধতি তাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে । এই কথাগুলো হয়তো ধর্মের ক্ষেত্রে
ততখানি গুরুত্বপূর্ণ নয়, কিন্তু সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে ভীষণভাবে
জরুরি । সম্প্রদায় মানুষকে ভাগ করে রাখে । সম্প্রদায় আছে বলেই হিন্দু নারী বিয়ের পর
শাঁখা পরে, মুসলমান নারী তা পরে না । এই সম্প্রদায়ের জন্যেই
একজন মুসলমান নারীকে বোরখা পরতে হয়, হিন্দু নারীকে তা পরতে
হয় না । সম্প্রদায় আছে বলেই ছেলেরা মেয়েদের সামনে পোশাক বদল করে, কিন্তু উল্টোটা, অর্থাৎ মেয়েরা সেটা পারে না ।
এই নীতি লঙ্ঘন করলেই সম্প্রদায় তাদের টুঁটি চেপে ধরবে । এই কারণে লাইব্রেরিতে মহাকাব্য
বা বিখ্যাত গ্রন্থগুলো রাখা থাকে সবচেয়ে উঁচু তাকে, সিলিংয়ের
কাছে, ধুলোর মধ্যে । কারণ, সাধারণ
মানুষ সেগুলো পড়ে না । মানুষ যেগুলো পড়ে তার অধিকাংশই হল প্রচলিত গ্রন্থ । সেইসব
বইতে একচেটিয়া কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লেখা থাকে । যেমন, গীতা-কোরান-বাইবেল-ত্রিপিটক-জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব, প্রায় সবকটিতেই লেখা আছে একেশ্বরবাদের কথা, কিন্তু
সম্প্রদায় প্রচার করে 'আমার ঈশ্বর বাকিদের চেয়ে বড়'
। মানুষকে এরা ভাগ করে নিয়েছে শাসনের সুবিধার জন্য । ম্যাকিয়াভেলি
প্রথম বলেছিলেন, 'সাধারণ মানুষের ব্যবহার ও ব্যক্তিবোধ খুব
নিচু মানের । তারা সততা ও ভালবাসার মূল্য রাখতে জানে না । সেইজন্য সম্প্রদায় তাদের
ধর্ম ও সামাজিকতার ভয় দেখিয়ে শাসন করে ।' একই উচ্চারণ করেছিলেন
জার্মান দার্শনিক নীৎসে । তিনি বলেছিলেন, 'ধর্ম মানুষকে জীবন
বিমুখ করে রাখে, প্রশ্নহীন করে তোলে । জিজ্ঞাসাবোধ ও বিশ্লেষণকে
চাপা দিয়ে রাখতে চায় । এর ফলে মানুষ যে নিরাপত্তাময় জীবনের সন্ধান পায় সেখান থেকে তাকে
অানুগত্যের আওতায় আনা যেতে পারে । অপরপক্ষে, বিজ্ঞান মানুষকে
উপাদানে পর্যবসিত করে । তাৎক্ষণিক প্রমাণকে দূরগামী সত্যের আওতার বাইরে নিয়ে যায় ।
মানুষকে আধিপত্যগামী করে প্রভুত্বলাভের অধিকারী করে তোলে ।'
নীৎসের এই যুক্তি
থেকে আমরা জানতে পারি অধিকাংশ মানুষ দেখায় বিশ্বাসী, অথচ ভিতরে ভিতরে বোঝার ক্ষমতা
তাদের সরে দাঁড়াচ্ছে । আর্থার শোপেনহায়ার তাঁর 'নৈরাশ্যবাদী
দর্শন'-এ উল্লেখ করেছেন, সত্যিকারের
জীবন আবিষ্কার হয় প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বাইরে গিয়ে, প্রথা
থেকে দূরে, প্রকৃতির সংসর্গে, একাকী
বেঁচে থেকে ।
এই ব্যাপারাটা এখন
প্রতারণা ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে মিশে এক হয়ে গেছে । আধুনিক মানুষ প্রেমকে হাতিয়ার
রূপে ব্যবহার করতে শিখেছে । আমাদের দেশে যারা নারীমুক্তির জন্য লড়াই করছে, তাদেরই একাংশ
পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা নিয়ে নারীর প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদার বিরোধিতা করছে । এই
প্রভুত্বকারী ফ্যাসিস্টতুল্য মানসিক প্রবৃত্তি তাদের নারীমুক্তির চেয়ে বেশি করে পুরুষবিরোধিতার
দিকে ঠেলে দিচ্ছে । ফলে সত্যিকারের দুঃস্থ নারীরা এতে উপকৃত হচ্ছেন না, বরং তাদের অভাব ও দুর্দশা কিংবা তাদের ওপর হয়ে চলা সমাজের নিপীড়নকে কাজে
লাগিয়ে সাহায্যকারীরা প্রচারের আলোয় এসে নাম তৈরি করে ফেলছে । শিশুদের অবস্থা আরও অসহনীয়
। তাদেরকে সরকারিভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে 'নারী ও শিশুকল্যাণমন্ত্রক'-য়ের সঙ্গে । এটা ঠিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার বা পরিবারকল্যাণমন্ত্রকের
অধীনে আনার বিপরীত কাজ । ফলে শিশুর জন্য সরকারকে আলাদা করে বাজেট অনুমোদন করতে হচ্ছে
না । একটা প্রজাতান্ত্রিক দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকারি পুঁজি যদি বিদেশি
বিনিয়োগের ওপর নির্ভরশীল হয়, তা হলেই সমাজতন্ত্রের এমন বিশ্রি
নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায় । স্বাস্থ্য, পরিবার, নারীকল্যাণ ও শিশুবিভাগকে যদি পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া যায়,
তবে আর্থিক অনুমোদন কমিয়ে আনা যায় নাগরিক খাতে, এবং বাড়তি অর্থ রাষ্ট্র তার প্রতিরক্ষা বাজেটে ও সামরিক অস্ত্র কেনার উদ্দেশ্যে
ব্যবহার করতে পারে । এ হল নব্যগঠিত ধনতন্ত্রবাদ, যা সমাজতন্ত্রকে
ভিতর ও বাইরে থেকে সমান্তরালভাবে কুরে কুরে খাচ্ছে । এর সম্ভাব্য শিকার কাশ্মীরের শিশুরা
। তারা জন্ম থেকে সেনাবাহিনীর বুটের আওয়াজ শুনে সন্ত্রস্ত । সৌন্দর্য ও পর্যটন শিল্প
ছাড়া কাশ্মীরে উইলো কাঠ থেকে প্রস্তুত ক্রিকেট ব্যাট, উলের
পোশাক ও স্যাফ্রন বাদে আর তো তেমন বিশেষ কিছুই পাওয়া যায় না । কেননা, হিমাচলের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে ওখানে আপেল ব্যবসায় দারুণ মন্দা । তবু
দেশের সীমান্ত অঞ্চল বলে এবং পাকিস্তান অধুষ্যিত অঞ্চলের পাশের একটি অংশ বলে ভারত সরকার
দীর্ঘদিন ধরে সেখানে সেনার একটা বড় অংশ মোতায়েন করে রেখেছে অনেক টাকা সামরিক খরচ সামলেও
। প্রশ্ন হচ্ছে কেন ? দুই দেশের সরকারের যুক্তি হল সীমান্ত
সুরক্ষা, লাইন অব কন্ট্রোলের ওপর নজরদারি । তাই যদি হবে,
কাশ্মীরিদের মধ্যে তা হলে এত সেনাবিদ্বেষ দেখা দিল কেন ? কারণ, দীর্ঘদিন ধরে সেখানকার মানুষ অত্যাচারিত
এবং রাষ্ট্রদ্বারা ব্যবহৃত । এমনকী মৌলিক চাহিদাও পূরণ করা হয় না ওখানে । ওষুধ ও হাসপাতাল
অনুন্নত, রেশনব্যবস্থা ভাল নয়, এবং
কাশ্মীরের সরকারের কোনও প্রভাব সেখানে তেমনভাবে খাটানো যায় না । অর্ধেক মন্ত্রীসভার
সদস্যরা গৃহবন্দি কেন্দ্রের নির্দেশে । ফলে রাষ্ট্রবিরোধী ও সেনাবিদ্বেষ থেকে সাধারণ
জনতার মনে ঘৃণা ফুটে ওঠাটাই স্বাভাবিক । এর ফলে তারা একদিন পৃথক পতাকা তৈরি করে বিচ্ছিন্নতাবাদের
ডাক দিল । সেই বিচ্ছিন্নতাবাদীরা প্রথমে সেনার দখলে থাকা জমি ফেরত দিল মানুষকে । শিক্ষাঙ্গন
ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো থেকে সেনার টহলদারি সরিয়ে দিল । খাদ্য, রুজিরুটি এবং গণবন্টনব্যবস্থার লক্ষ্যে তারা কাশ্মীরের মানুষকে রাজনৈতিক
মতাদর্শে দীক্ষিত করল । ফলে সেখানকার মানুষও সেনাবিরোধী ঘৃণার আন্দোলনে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের
আশ্রয় দিল, খাদ্য দিল, নিরাপত্তা
দিল এবং সমর্থন জানিয়ে তাদের হাতে তুলে দিল নিজেদের ঘরের সন্তানকে ।
সরকার মুখে যাই বলুক, সদিচ্ছা থাকলে
এবং সরকার গঠনে ভূমিকা রাখা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সমর্থন নিয়ে, কখনও এককভাবে কিংবা যৌথ সরকার চলিয়ে আইনত বাধাগুলোকে টপকে তারা কাশ্মীরিদের
জন্যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারত, এবং সেই সঙ্গে অন্যান্য
নাগরিক সুবিধা তারা এতদিনে দিতে পারত । কিন্তু দিল্লির ক্ষমতাকে মাথায় রেখে,
এবং ইসলামাবাদের সঙ্গে কূটনৈতিকের সম্পর্কের কথা খেয়াল রেখে তারা
কাশ্মীরিদের জন্যে তেমন কিছুই করেনি, যা দেশের অন্যান্য রাজ্যের
জন্য তারা এতদিন করেছিল । ফলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সরকার বিরোধিতাকে পাকমদতপুষ্ট জঙ্গি
সংগঠনরা নিরন্তর কাজে লাগিয়ে গিয়েছে, এবং বলাবাহুল্য তার পিছনে
কলকাঠি নেড়েছে বিরাট আন্তর্জাতিকতাবাদ ও বিদেশি পুঁজির বিনিয়োগ । কেননা, দারিদ্র নিঃশেষ করতে ব্যর্থ ভারত সরকার কখনো মার্কিন পুঁজির বিরোধিতা করেনি
। একজন সাধারণ কাশ্মীরি ব্যবসায়ী বিনাশর্তে
অল্প দামে সরকারকে যে কাঁচামাল বিক্রি করেছে, সরকার তাকে তার
বিনিময়ে খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানী বিক্রি
করেছে বিশ্বপণ্যের দামে । ফলে, সামান্য দু'বেলার খাবার জোটাতে অনেক কাশ্মীরিকে উদয়াস্ত খাটতে হয়েছে । খেতভরা শস্য
থাকা সত্ত্বেও বা চাষের জমির মালিক হওয়া সত্ত্বেও তাদের বাড়ির মেয়ে বৌকে পর্যটন হোটেলে
বাসনমাজার কাজ করতে হয়েছে ।
দীর্ঘকাল ধরে চলে
আসা এই যুদ্ধ ও সেনা ক্যাম্পের ওপর আক্রমণ ও প্রতিআক্রমণের মধ্যে সাধারণ কাশ্মীরিদেরকে
ঠেলে দিয়েছে খোদ সরকারই । সরকার প্রেস বিবৃতি যাই দিক, কাশ্মীরে
মোতায়েন সেনাবাহিনীর অনেকরই ধারণা হয়ে গেছে প্রতিটি কাশ্মীরিই হল সম্ভাব্য জঙ্গি এবং
সরকার বিরোধী । যেহেতু, অনেক আগে থেকেই ওয়েলফেয়ার স্টেটের
নামে ইউরোকমিউনিজমের বদল ঘটেছিল । সুতরাং, নতুন কমিউনিজম পুঁজির
বিরুদ্ধে না গিয়ে পুঁজির অস্তিত্বকে মেনে নিয়েই সমবন্টনের দাবিতে রাষ্ট্রীয় অান্দোলন
করতে লাগল । তাদের লক্ষ্য হল নব্যধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কাশ্মীরে সমাজতন্ত্র
প্রতিষ্ঠা ও সরকারের রাজনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্ত 'কাশ্মীরে শান্তিরক্ষার'
বিরোধিতা করা । প্রতিটি শিশুই ওখানে রক্তে এই সমাজতান্ত্রিক যুদ্ধের
আবহ নিয়ে জন্মাতে লাগল । সরকার সেই সম্ভাব্য নবগঠিত লড়াইকে দেশ ও জাতীয়তাবাদ বিরোধী
অাখ্যা দিল । ঠিক একইভাবে যাদবপুর ও জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের কাশ্মীরিদের পক্ষ
নেওয়া ছাত্রছাত্রীকেও কম্যুনিস্ট তথা পরোক্ষ সন্ত্রাসবাদের সমর্থনকারী হিসাবে সরকার
ভাবতে থাকে । শুধু এটুকুই বলার, কাশ্মীরিরা লড়ছে সমগ্র ভারতবাসীর
জন্যে, আর সরকার লড়ছে ওদের নাগরিক অধিকারের বিরুদ্ধে,
সেনা দিয়ে ।
নিজের বিষয়ে একটু
ফিরি । এইসব বাস্তব জীবন থেকে আমি পাই এক অদ্ভুত স্তব্ধতা, যা আমার ভিতরটা
ভরাট করে ঠিকই, কিন্তু সৃষ্টির জন্যে যা কিছু তা আমি অর্জন
করি আমার নিজস্ব গতির জীবন থেকে । আজকের দিনে, আমার মনে হয়েছে,
একজন মানুষ হিসাবে শিক্ষিত হওয়ার চেয়ে বড় বেশি জরুরি আমার মানবিক
হওয়া । আমি তাই হয়েছি, সকলের কাছে জানতে চেয়েছি 'সুস্থতা ও স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির' সংজ্ঞা ঠিক কী
? জানতে চেয়েছি আমার সঙ্গে সঙ্গে সেরে উঠবে কি না আমার পারিপার্শ্বিক
সভ্যতা ও সচেতনতাগুলো ! —আমাকে কেউ সুদত্তর দিতে পারেনি এসবের
। যেহেতু আমার জীবনের ভিতরে কোথাও ফাঁক ছিল না, জায়গাগুলো
ভরাট ছিল প্রশ্নে, তাই সৃষ্টিগুলো বেরিয়ে পড়ত, যেমন করে তাদের প্রকাশিত হওয়া উচিত । কারোর চোখে আমি ছিলাম হীন,
তুচ্ছ । কারোর চোখে অপরাধী, ক্ষমাহীন,
অমার্জনীয় । কেউ আমায় বিশ্বাস করল, কেউ ফেলে
রাখল অবিশ্বাসের দরজায় । কারোর-বা জীবনের ওপর দিয়ে গড়িয়ে
গেল আমার জীবন । আমি কারোর কথার অংশ হলাম, কারোর-বা মনের অংশ । কারোর জীবনে আমি স্রেফ একটা ভুল, হঠাৎ ভ্রান্তিতে পা দেওয়া একটা কিছু । কারো কারো জীবনে আমি শুধু একটা ঘটনা,
যেটা সে ভুলতে চায় । বস্তুত, আমি একটা মানুষ,
সমাজ যাকে ভেঙে টুকরো করে বাঁচিয়ে রাখল অনেকগুলো মানুষের ধারণায়,
অনুমানে ও দৃষ্টিকোণে ।
( চলবে
)
খুব জোরালো ও জরুরি লেখা।
ReplyDeleteআপনার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ হওয়া দরকার।
কেন দরকার, সেটা আমার পত্রিকার একটি সংখ্যা দেখলেই বুঝবেন। ধন্যবাদ নিন।