বাক্‌ ১৪২ ।। রাজীব দত্ত ।। রেয়ার স্পিসিস




এবছর বেশ চোখধাঁধানো বসন্ত নেমেছে দিল্লিতেফুলে ফুলে ভরে গেছে শহর। রূপের কি মানে যদি সেই রূপ দেখে কেউ না মজল! ফি বছর পলিউশান থাকে, মানুষও থাকে। দিল্লির পরিচিত পায়রাদের মতো মেয়েরাও তাদের রূপ ছড়িয়ে দিয়ে মুক্ত বিহঙ্গের মতো ঘুরে বেড়ায়। বছর বসন্ত আছে, ফুল আছে, পাখি আছে সুন্দরের আসল রহস্যই নেই। নারী না থাকলে পৃথিবীটা বড় অসুন্দর।
ফাঁকা রাস্তায় একা হাঁটতে হাঁটতে নিজেকে বেশ, ওয়ানস আপন এ টাইম, দেয়ার ওয়াজ এ কিং... দু’-চারটে গাড়ি হুশ করে বেড়িয়ে গেলেও খুব একটা ডিস্টার্ব বোধ হচ্ছে না। আপন মনেই হাঁটছিল। কিছুটা যেতেই, একটি মেয়ের মুখোমুখি, একটু অসাবধান হলেই ধাক্কাটা লেগেই যেত। স্যরিবলে, কোনওমতে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই মেয়েটি বলল, ‘চিনতে পারছ? এখনও ফাঁকা রাস্তা পেলেই একা-একা হেঁটে বেড়াও! রাজার মতো! একটুও পালটালে না তুমি। অচেনা কোনও মেয়ে হলে কিন্তু ধাক্কাটা সহ্য করতে পারত না। বুঝলে!’
এতগুলি কথা বলার পরেও চেনা গেল না আমাকে? স্ট্রেঞ্জ!’
‘না মানে কিছুতেই মনে করতে পারছি না। নামটা বলবেন প্লিজ! আর আমি অন্যমনস্ক ছিলাম, তাই এই ফাঁকা রাস্তায় এই সময়ে কাউকে এক্সপেক্ট করিনি।’
‘তোমার প্রেসিডেন্সির ১৯৯০ ব্যাচ। রাহুল আমি কি অনেকটাই বুড়িয়ে গেছি এই ক’দিনে, খুব বিচ্ছিরি হয়ে গেছি দেখতে, যে মনে করতে পারছ না!
মেয়েদের এই এক সমস্যা, বিষয়টা যাইহোক না কেন, তাদের নিজের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী তাদের সৌন্দর্য। রূপ অভিমানে, লজ্জায় বা নির্লজ্জতায়ও প্রাধান্য পায়,  প্রেমে-অপ্রেমেও সেই রূপ। শেষ পর্যন্ত হেরে গেলেও অভিসম্পাত দেয় নিজের সৌন্দর্যকেই। সুচিত্রা সেন নাকি  দেখতে বিচ্ছিরি হয়ে যাচ্ছিলেন বলেই নিজেকে চার দশক ঘরবন্দি করে রেখেছিলেন। রূপ হারানোর এই অসুখ মেয়েদের চিরন্তন। এর কোনও চিকিৎসা নেই। রাহুলের এই মুহূর্তে কোনও ইন্টারেস্ট নেই মাঝরাস্তায় অন্য নারীকে চেনার। কোনও দায়ও নেই। ছোট্ট করে উত্তর দিল, ‘স্যরি আমি মনে করতে পারছি না।’
‘দেখো রাহুল, জীবনটা হেঁয়ালি নয়। প্রায় ষোলো বছর পর এভাবে দেখা হয়ে যাবে এই শহরে আমি ভাবতেই পারিনি। এমন একটা দিন যায়নি যে, আমি তোমায় খুঁজিনি। তোমার ঠিকানায়, ফেসবুকে, ফ্রেন্ডসসার্কেলে। কেউ তোমার খোঁজ দিতে পারেনি। আই অ্যাম স্যরি। প্লিজসামনেই আমার কোয়ার্টার, চলো চা খাবে। তোমার প্রিয় চা সঙ্গে কুকিস। চলো।’
নামটাও জানে! মানে খুব পরিচিত। কিন্তু কস্মিনকালে মেয়েটিকে দেখেছে বলে মনে পড়ছে না তার। চুপ করে ভাবার চেষ্টা করছে, কে মেয়েটি!
হাতটা ধরে উচ্ছল কিশোরীর মতো মেয়েটি বলল, ‘চলো, আমি নিজে হাতে চা করে খাওয়াবকলকাতার খাস্তা আছে। ডিনার সেরে ফিরবে।
বেশ শক্ত করে হাতটা ধরে রেখেছে মেয়েটি। রাহুল হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে, ‘আপনি ভুল করছেন কোথাও। শুনুন, দাঁড়ান, আপনি ভুল করছেন কোথাও। আমি আপনার পরিচিত রাহুল নই।’
হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে হনহন করে হাঁটছে মেয়েটি। সময়ে মেয়েরা পুরুষের থেকেও কঠিন হয়ে ওঠে।
লিফটে উঠেও শক্ত করে ধরে রেখেছে রাহুলকে। দু’জন দু’জনায় প্রায় লেগে আছে। মেয়েটির শরীরে মিষ্টি ফরাসি গন্ধ। রাহুল যেন মোহাবিষ্ট।
ফ্ল্যাটে ঢুকেই একটা জয়েন্ট ছবি। মেয়েটি আর ওর বর হবে হয়তো।
চেঞ্জ করে হাতে চা আর কুকিস নিয়ে এলএবার অনেকটাই মাইল্ড, পরনে শাড়ি, চুল ছেড়ে রেখেছে। এই কুকিস চা রাহুলের হট ফেভারিট।
অনেককিছু বলে গেল মেয়েটি। ডিনার করিয়েই ছাড়ল। হাসব্যান্ড ইন্ডিয়ান আর্মিতে ছিল। ১৯৯৯-এর কার্গিল যুদ্ধে নিহত। তারপর থেকে একাই থাকে এই ফ্ল্যাটে। একটা স্কুলে পড়ায়।
একা নিজের ফ্ল্যাটে আলো নিভিয়ে শুয়ে আছে রাহুল। রিয়াকে চিনতে পারল না! কলেজের ফার্স্ট ইয়ারেও না, ষোলো বছর আগেও না, আর আজ সন্ধ্যায় আরও অচেনা।
চেনা পাখিগুলি রেয়ার স্পিসিস আজ। বেশ গালভরা শব্দ। রিয়াও অচেনাই থাকুক।

No comments:

Post a Comment