চলে গেলেন শম্ভু রক্ষিত। কিন্তু সত্যিই কি কোথাও গেলেন? এতদিনে, এবার হবে, মহাকালের সঙ্গে তাঁর নিষ্পত্তি। মহাকাল, কাল, সময়। তার উপরে কী আছে মানবজীবনে? স্থানের চেয়ে তাকে আলাদা করা কি যায়? যেমন আমি বারবার বলেছি অনলাইনই বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ। আজ সে কথা প্রমাণিত হল। এই কথা আজ থেকে দশ বছর আগে পশ্চিমবঙ্গে বিদ্রুপের বিষয় ছিল। তখন যাঁরা বাঁকা হাসি হাসতেন, আজ তাঁদের হাসি করোনার এই সময়ে মাস্কের আড়ালে চাপা পড়েছে। এতে দুঃখিত হব, না আনন্দিত হব? এভাবে প্রমাণ হোক, চাইনি। প্রিন্ট মিডিয়ায় সবেমাত্র আমরা কিছু কাজ শুরু করেছি। সেসব কাজ বাকি আছে। কয়েকটি বই প্রকাশিত হতে গিয়েও আটকে আছে। এখনও দুই মাধ্যম মিলিয়ে চলা প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গের নামকরা মিডিয়ালালিত লেখক-কবিরা এখন ধুমধাম করে অনলাইনের ক্ষীর খাচ্ছেন। আজ থেকে ১০ বছর আগে তাঁরা ব্লগকে পাত্তা দিতেন না। এখন তাঁরাই ব্লগের মুখাপেক্ষী। উপেক্ষা অনাদর সহ্য করতে করতে যারা অনলাইন বাংলা সাহিত্যের জন্য এক দশক লড়ল, দেখা যাবে তারা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। এটাই এ দেশের রীতি।
মানুষ যে মানুষকে স্পর্শ করে কতকিছু বুঝিয়ে দিতে পারে, যেখানে ভাষার মৌখিক রূপ অচল সেখানেও! করোনা আমাদের পৃথিবীকে ইতিমধ্যেই দুটি কালখণ্ডে ভেঙে দিয়েছে। করোনা এই পৃথিবীতে আসার আগে মানুষের পৃথিবী এক ছিল, করোনা যখন চলে যাবে, তখন হয়ত পুরনো সমাজব্যবস্থা তো বটেই, অনেক মানবিক ব্যাপারও যাবে আগাগোড়া বদলে। সমগ্র রাষ্ট্রকে যেমন আজ লকডাউন করতে হয়েছে, একদিন সেই লকডাউন উঠেও যাওয়ার কথা রেখেই তা করা হয়েছিল। পৃথিবীতে কোনো অন্ধকার চিরস্থায়ী নয়। মানুষের বাঁচার ইচ্ছার চেয়ে জোরালো কিছুই নেই। কিন্তু, অন্ধকারের আগে একটা দিন থাকে, অন্ধকারের পরের সকাল থেকে আরেকটা দিবস শুরু হয়, এবং সেই দুটি দিবাভাগ একে অন্যের সঙ্গে মেলে না, তাদের একজনের নাম যদি সোমবার হয়, পরেরটির নাম হতেই হয় মঙ্গলবার, এবং ক্যালেন্ডারে তাদের জন্য আলাদা আলাদা ঘর বরাদ্দ থাকে। করোনার অন্ধকার সময়টাও কেটে গিয়ে যখন আমাদের জীবনের এই করাল বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের দিনগুলোকে বিচ্ছিন্ন করবে, কেবল নামেমাত্র নয়, তখন আমাদের পারস্পরিক আচরণ আর আগের জায়গায় উজ্জ্বল থাকবে কি?
মানুষ যে মানুষকে স্পর্শ করে কতকিছু বুঝিয়ে দিতে পারে, যেখানে ভাষার মৌখিক রূপ অচল সেখানেও! করোনা আমাদের পৃথিবীকে ইতিমধ্যেই দুটি কালখণ্ডে ভেঙে দিয়েছে। করোনা এই পৃথিবীতে আসার আগে মানুষের পৃথিবী এক ছিল, করোনা যখন চলে যাবে, তখন হয়ত পুরনো সমাজব্যবস্থা তো বটেই, অনেক মানবিক ব্যাপারও যাবে আগাগোড়া বদলে। সমগ্র রাষ্ট্রকে যেমন আজ লকডাউন করতে হয়েছে, একদিন সেই লকডাউন উঠেও যাওয়ার কথা রেখেই তা করা হয়েছিল। পৃথিবীতে কোনো অন্ধকার চিরস্থায়ী নয়। মানুষের বাঁচার ইচ্ছার চেয়ে জোরালো কিছুই নেই। কিন্তু, অন্ধকারের আগে একটা দিন থাকে, অন্ধকারের পরের সকাল থেকে আরেকটা দিবস শুরু হয়, এবং সেই দুটি দিবাভাগ একে অন্যের সঙ্গে মেলে না, তাদের একজনের নাম যদি সোমবার হয়, পরেরটির নাম হতেই হয় মঙ্গলবার, এবং ক্যালেন্ডারে তাদের জন্য আলাদা আলাদা ঘর বরাদ্দ থাকে। করোনার অন্ধকার সময়টাও কেটে গিয়ে যখন আমাদের জীবনের এই করাল বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের দিনগুলোকে বিচ্ছিন্ন করবে, কেবল নামেমাত্র নয়, তখন আমাদের পারস্পরিক আচরণ আর আগের জায়গায় উজ্জ্বল থাকবে কি?
যদি দেশ থেকে শেষতম করোনা রোগীটিও বা করোনার বাহকটিও সুস্থ ও সংক্রমণমুক্ত হয়ে
যান, তাহলেও মানুষের মনের কোণে এক কণা অবিশ্বাস আর সংশয় রয়ে যাবে না কি? সেটা থেকে
সুস্থ হতে বহু মানুষের আবার হয়ত লাগবে কিছু সময়। ডিপ্রেশন আর উৎকণ্ঠার এক অকারণ
অযৌক্তিক ছায়া থেকে তখন মুক্ত হতে হবে। দেশজুড়ে তখন এক প্রবল অর্থনৈতিক মন্দা, তার
মধ্যে মানুষের মন থেকে মুছে গেছে আরেকজন মানুষের স্পর্শের প্রতি যে আস্থা যে
শ্রদ্ধা, এমন অবস্থায় করোনা-পরবর্তী সমাজের ছবি কেমন হবে? প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে
যেমন পৃথিবী জুড়ে সনাতন মূল্যবোধগুলোর প্রতি নিঃশর্ত আস্থা ও শ্রদ্ধা রাখতে পারত
মানুষ, বিশ্বযুদ্ধের পরে আর তা সম্ভব হয়নি। মানুষ যে কত নির্মম হতে পারে, কোনোরকম
ব্যক্তিগত ক্রোধ ছাড়াই একজন মানুষ কেমন অনায়াসে যান্ত্রিকভাবে অগণিত মানুষের
মৃত্যু ঘটাতে পারে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল। শান্তির ললিত
বাণীকে তখন ব্যর্থ পরিহাস ছাড়া আর কিছু মনে হওয়া সম্ভব ছিল না। করোনার পরে যে
পৃথিবী আসবে, সেখানে মানুষের স্পর্শ আর ভিড়ের মধ্যে অজানা অচেনা অজস্র মানুষের শারীরিক
সান্নিধ্যকে সহজভাবে মেনে নিতে অনেক হয়ত সময় লাগবে। একটা ভিড় বাসে উঠে প্রত্যেকে
প্রত্যেকের দিকে তখন আড়চোখেই তাকাব আমরা, খুব অক্লেশে একজনের পাশের ফাঁকা সিটে হয়ত
বসে পড়তে পারব না।
করোনার পরের যে পৃথিবী দেখা দিচ্ছে, হয়ত সেই পৃথিবীতে তখন একজন সংক্রমিত কেউ অবশিষ্ট নেই, নিশ্চয়ই
সবাই সুস্থ হয়েছেন, কিন্তু তখন কী হবে সিনেমাহলগুলোর? মাল্টিপ্লেক্সের? নাটকের?
ক্রিকেট বা ফুটবল ম্যাচে গ্যালারি ভর্তি দর্শকের? খুব শীঘ্র কি তারা আবার মানুষের
ভিড়ে ভরে যাবে? নাকি এক সর্বগ্রাসী নিরাপত্তাহীনতার বোধ মানুষের প্রত্যেক সমবেত আনন্দ উৎসবকে তখন চেপে
রাখতে চাইবে? আজ যে শিক্ষক ভিডিও চ্যাটের মাধ্যমের তাঁর ছাত্রছাত্রীকে পড়াচ্ছেন
গৃহবন্দী অবস্থায়, তখন কি তিনি খুব সাবলীলভাবে ক্লাসরুমে প্রবেশ করবেন, যেখানে
অনেকক্ষেত্রেই ৭০-৮০ জন ছেলেমেয়ে বসে আছে, পাশাপাশি, একটাই ঘরের মধ্যে, হয়ত
মাঝেমধ্যে কেউ সামান্য হেঁচে ফেলছে, বা কারও গলায় খুবই সাধারণ একটু ব্যথা হয়েছে? একজন
সামান্য অসুস্থ মানুষকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে কি তখন অসুবিধা হবে আমাদের
অনেকের? বাসের মধ্যে বা ট্রেনের কামরায় প্রতেক হাঁচি আর কাশিকে কি সন্দেহ করা হবে?
আমাদের হাতগুলো তখন কোথায় থাকবে?
মহামারি বিদায় নিলে সবাই অমন সন্দেহ অবশ্যই করবেন না। সন্দেহের ধাত সবার হয়
না। মনের একটা স্থায়ী বিকার সবার হয় না। আজই কত লোক লকডাউন উপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়ছেন,
পুলিশকে এড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছেন কত উচ্ছ্বল তরুণ পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম ও শহরে রাস্তায়
গলিতে! তাঁরা বিশ্বাসই করেন না তাঁদের করোনা হতে পারে, বা করোনা নামক রোগটা
কোনোভাবে তাঁদের গ্রাম বা শহর বা পাড়ায় প্রবেশ করতেই পারে! নিজেদের অনাক্রম্যতার
প্রতি তাঁদের অপরিসীম আস্থা আজ অনেকের বিপদের কারণ। কিন্তু যেদিন করোনা আমাদের
বিদায় দিয়ে চলে যাবে, সেদিন এই বেপরোয়া লোকগুলোর মানসিক স্বাস্থ্যকে হয়ত আমরা
অনেকেই একটু ঈর্ষা করব। মহামারিকে আমরা যত ভয়
পেয়েছি, তারা তা পায়নি। তারা তুচ্ছ করতে পেরেছে নিজেদের অসুস্থ
হয়ে পড়ার সম্ভাবনাকে। তারা অসামাজিকভাবে লকডাউনের মধ্যে বিড়ি টেনেছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে,
পুলিশ দেখলেই পালিয়েছে। তারা সকালে চায়ের দোকানের খোঁজে বেরোচ্ছিল, যে চায়ের দোকান নিষিদ্ধ মদের দোকানের
মতোই কোনো গোপন কোণে হয়ত এক চিলতে খোলা হচ্ছে। তখন তাদের কাছে কৈফিয়ত চাইলে তারা
অবাক হয়ে বলেছে- “চা খাবো না আমরা? খাবো না আমরা চা?” তারা জানেই না জীবনে চায়ের
মূল্য স্বয়ং জীবনের চেয়ে বেশি নয়। তারা মহামারির পরিস্থিতিতে কতখানি অন্যায় করছে
সে বিষয়ে নিজেরাই সচেতন নয়। ইতালি বা আমেরিকার করুণ
উদাহরণ তাদের সামনে তুলে ধরলেও যে সেই চেতনা জাগবে এমন নয়। কিন্তু, এটা যেমন ঘটনা
যে তাদের দায়িত্ববোধ নেই, কিন্তু তাদের মন এতই দাগহীন যে মহামারির পরেও তারা হয়ত
খুব সহজভাবে মেনে নেবে পরিবর্তিত সমাজকে, তখন তারা অনায়াসেই একজন অচেনা মানুষের
দেহকে স্পর্শ করে বাসে বা ট্রেনে যাতায়াত করতে পারবে।
আমরা যারা অনবরত করোনা সম্পর্কে সন্ধান করছি, টিভিতে দেখতে চাইছি তার
সাম্প্রতিকতম পরিস্থিতি, আন্তর্জালে অহরহ খুঁজে বেড়াচ্ছি কোভিড ১৯ ভাইরাসের
কোষ্ঠীঠিকুজি, প্রতি মুহূর্তে আলোচনা করছি, ভয় পাচ্ছি, আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে লক্ষ্য
করছি নিজেদের গলার মধ্যে কোনো ব্যথা হচ্ছে কিনা, বা শরীরের তাপমাত্রা ঠিক আছে
কিনা, অসুখ হওয়ার আগে প্রতিদিন একবার অসুস্থ হয়ে পড়ছি হয়ত মনের কারণেই, তারা তখন
অত সাবলীল হতে পারব কি? বিশ্বাস কি করতে পারব যে মহামারি সত্যিই চলে গেছে আমাদের
রেহাই দিয়ে, এবং ফিরে আসার কোনো প্রতিশ্রুতি রেখে যায়নি? আমরা কি তখনও মুখে একটা
মাস্ক পরেই বাইরে বেরোব? যখন বাংলা ও ভারতের সকল পর্যটন কেন্দ্রগুলো উন্মুক্ত হয়ে
যাবে, তখনও কি আমরা সাহসের অভাব টের পাব না, বেরিয়ে পড়তে কি পারব সপরিবারে, ভিড়ের
মধ্যে? পার্কে বা চিড়িয়াখানায় যেতে দ্বিধা করব কি? মনে কি হবে, কোনো এক অদ্ভুত ও
দৈব ফিকিরে হয়ত আবার ফিরে আসবে করোনা, এবং আমি বা আপনিই হয়ে পড়ব তার প্রথম শিকার?
এমন দিন তো আসবেই যখন করোনা স্মৃতি হয়ে গেছে, এক দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে গেছে।
কিন্তু আমাদের কারও কারও হাতের চামড়ায় তখনও কি লেগেই থাকবে লম্বা হলুদ বা পাতলা
সাদা দস্তানাগুলোর স্পর্শ? প্রেমিক কি তার প্রেমিকার হাত ধরবে অনেকখানি অনধিকারের
ভাব বুকের মধ্যে নিয়ে, যেন সে এখনই সংক্রমিত করে ফেলবে তার প্রিয়তমা মানুষটিকে।
পৃথিবী থেকে করোনা চলে গেলেও তার আড়ষ্টতা থেকে যেতে পারে, শুকনো ক্ষতর মতো, বেশ
কিছুদিন আমাদের হাতের আঙুলে। এখন থেকেই আমাদের মনকে প্রস্তুত করা দরকার, ক্ষতটা
যেন দ্রুত শুকিয়ে যায়। সামাজিক দূরত্বের ধারণা যেন চেপে না বসে। সামাজিক কোনো দূরত্ব কেন একটা অসুখ আমাদের দেবে? দিয়েছিল শারীরিক দূরত্ব। সে দূরত্ব আমাদের নিকটতা আর আত্মীয়তার স্বার্থেই জরুরি ছিল। কিছু সময়ের জন্য। হ্যাঁ, সময়ই তা আবার মিটিয়ে দিচ্ছে।
আসুন, এই ভিডিওটিতে আমরা অমিতাভ বচ্চনের কন্ঠে জীবনের জয়গানটুকু শুনে নিয়ে সূচিপত্রে প্রবেশ করি? এই জীবনমুখী ভিডিও আমাদের দিয়েছেন শুভ্রশুচি চক্রবর্তী।
আসুন, এই ভিডিওটিতে আমরা অমিতাভ বচ্চনের কন্ঠে জীবনের জয়গানটুকু শুনে নিয়ে সূচিপত্রে প্রবেশ করি? এই জীবনমুখী ভিডিও আমাদের দিয়েছেন শুভ্রশুচি চক্রবর্তী।
অনুপম মুখোপাধ্যায়
পরিচালক-
‘বাক্ অনলাইন’